আমাদের শ্রীগুরুপরম্পরা :
শ্রীশ্রীল ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিরক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ ভগবান্ শ্রীশ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর
              প্রভুপাদ
“শ্রীচৈতন্য-সারস্বত মঠে সূর্যাস্ত কখনই হয় না” :
আমাদের মঠের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য
 
আমাদের সম্পর্কে শ্রীউপদেশ শ্রীগ্রন্থাগার শ্রীগৌড়ীয় পঞ্জিকা ছবি ENGLISH
 

শ্রীশ্রীপ্রেমবিবর্ত্ত


১৬। পীরিতি কিরূপ ?

 

শ্রীরঘুনাথদাস গোস্বামীর প্রশ্ন

একদিন রঘুনাথ স্বরূপে জিজ্ঞাসে ।

“কি বস্তু পীরিতি ? মোরে শিখাও আভাসে ॥১॥

বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস যে প্রীতি বর্ণিল ।

সে প্রীতি বুঝিতে মোর শক্তি না হইল ॥২॥

তাঁহাদের বাক্যে বাহ্যে বুঝে যে পীরিতি ।

সে কেবল স্ত্রীপুরুষের প্রণয়ের রীতি ॥৩॥

সে কেমনে পরমার্থ-মধ্যে গণ্য হয় ।

প্রাকৃত কামকে কেন অপ্রাকৃত কয় ॥৪॥

মহাপ্রভু তোমার সঙ্গে সেই সব গান ।

করেন সর্ব্বদা, তার না পাই সন্ধান ॥৫॥

প্রভু তব হস্তে মোরে করিল সমর্পণ ।

আজ্ঞা কৈল, ‘শিখাও একে নিগূঢ তত্ত্বধন’ ॥৬॥

প্রীতি-তত্ত্ব

কৃপা করি’ প্রীতিতত্ত্ব মোরে দেহ বুঝাইয়া ।

কৃতার্থ হইব মুঞি সংশয় ত্যজিয়া” ॥৭॥

উত্তর

স্বরূপ বলিল, “ভাই রঘুনাথদাস ।

নিভৃতে তোমারে তত্ত্ব করিব প্রকাশ ॥৮॥

আমি কিবা রামানন্দ অথবা পণ্ডিত ।

কেহ না বুঝিবে তত্ত্ব প্রভুর উদিত ॥৯॥

তবে যদি গৌরচন্দ্র জিহ্বায় বসিয়া ।

বলাইবে নিজতত্ত্ব সকৃপ হইয়া ॥১০॥


তখনই জানিবে হৈল সুসত্য প্রকাশ ।

শুনিয়া আনন্দ পাবে রঘুনাথদাস ॥১১॥

চণ্ডীদাস বিদ্যাপতিকর্ণামৃত রায়ের গীতি

এসব অমূল্য শাস্ত্র জান ।

এসবে নাহিক কামএসব প্রেমের ধাম

অপ্রাকৃত তাহাতে বিধান ॥১২॥
 
স্ত্রী-পুরুষ-বিবরণযে কিছু তঁহি বর্ণন

সে সব উপমা মাত্র সার ।

প্রাকৃত-কাম-বর্ণনতাহে কৃষ্ণ-অদর্শন

অপ্রাকৃত করহ বিচার ॥১৩॥
 
কি পুরুষ, কিবা নারী,এ-তত্ত্ব বুঝিতে নারি

জড়দেহে করে রসরঙ্গ ।

সে গুরু কৃষ্ণের ভাণেশুদ্ধ-রীতি নাহি জানে

তাহার ভজন মায়ারঙ্গ ॥১৪॥
 

কৃষ্ণপ্রেম

কৃষ্ণপ্রেম সুনির্ম্মলযেন শুদ্ধ গঙ্গাজল

সেই প্রেমা অমৃতের সিন্ধু ।

নির্ম্মল সে অনুরাগনাহি তাহে জড়দাগ

শুক্লবস্ত্র শূন্যমসীবিন্দু ॥১৫॥
 
শুদ্ধপ্রেম সুখসিন্ধুপাই তার এক বিন্দু

সেই বিন্দু জগৎ ডুবায় ।

জড়দেহে করি’ প্রীতিকেবল কামের রীতি

শুদ্ধ দেহ না হয় উদয় ॥১৬॥
 
দূরে শুদ্ধ প্রেমবন্ধকপট প্রেমেতে অন্ধ

সেই প্রেমে কৃষ্ণ নাহি পায় ।

তবে যে করে ক্রন্দনস্বসৌভাগ্য প্রখ্যাপন

করে ইহা, জানিহ নিশ্চয় ॥১৭॥
 
কৃষ্ণপ্রেম যার হয়তার বিভাব চিন্ময়

অনুভাব দেহেতে প্রকাশ ।

সাত্ত্বিকাদি ব্যভিচারীচিন্ময়-স্বরূপ ধরি’

চিৎস্বরূপে করয়ে বিলাস ॥১৮॥
 
ধন্য সেই লীলাশুককৃষ্ণ তারে হয়ে সম্মুখ

দিল ব্রজের অপ্রাকৃত রস ।

ছাড়িল এদেহ-রঙ্গপ্রাকৃতালম্বন-ভঙ্গ

তাহে কৃষ্ণ পরম সন্তোষ ॥১৯॥
 
বিদ্যাপতি চণ্ডীদাসছাড়ি’ পূর্ব্ব রসাভাস

অপ্রাকৃত-রসলাভ কৈল ।

পূর্ব্বে ছিল তুচ্ছ রসতাহা ছাড়ি’ প্রেমবশ

হঞা, কৃষ্ণভজন লভিল ॥২০॥
 
তুচ্ছ রসে মাতোয়ারনা পায় কৃষ্ণরস-সার

নহে বংশীবদনালম্বন ।

জড় দেহে সাজে সাজমাথায় তার পড়ে বাজ

প্রাণকীটের করয়ে ধারণ ॥২১॥
 
সেই তুচ্ছ রস ত্যজি’শ্রীনন্দনন্দন ভজি’

দেখে কৃষ্ণ শ্রীবংশীবদন ।

নিজে গোপীদেহ পায়ব্রজবনে বেগে যায়

পূর্ব্ব সঙ্গ করয় ত্যজন ॥২২॥
 

তথাহি মহাপ্রভুর শ্লোক ঃ—

‘ন প্রেমগন্ধোঽস্তি দরাপি মে হরৌ

ক্রন্দামি সৌভাগ্যভরং প্রকাশিতুম্ ।

বংশীবিলাস্যাননলোকনং বিনা

বিভর্ম্মি যৎ প্রাণপতঙ্গকান্ বৃথা’ ॥২৩॥

ব্রজগোপী ব্যতীত পীরিতি বুঝে না

পীরিতি পীরিতি পীরিতি বলে পীরিতি বুঝিল কে ? ।

যে জন পীরিতি বুঝিতে পারে ব্রজগোপী হয় সে ॥২৪॥

পীরিতি বলিয়া তিনটী আঁখর বিদিত ভুবন-মাঝে ।

যাহাতে পশিল সেই সে মজিল কি তার কলঙ্কলাজে ॥২৫॥

ব্রজগোপী হঞা চিদ্দেহ স্মরিয়া জড়ের সম্বন্ধ ছাড়ে ।

বিষয়ে আশ্রয়ে শুদ্ধ-আলম্বন পরকীয়-রস বাড়ে ॥২৬॥

ব্রজ বিনা কোথাও নাহি পরকীয়-ভাব ।

বৈকুণ্ঠ-লক্ষ্মীতে তার সদা অসদ্ভাব ॥২৭॥

সহজিয়ার প্রীতি

সংসারে যতেকপুরুষ, রমণী

আলম্বন-দোষে সদা ।

রক্তমাংসদেহেআরোপ করিতে

নারকী হয় সর্ব্বদা ॥২৮॥
 
অতএব তারাসহজ-সাধনে

কৃষ্ণকৃপা যবে পায় ।

জড়দেহগন্ধছাড়িয়া সে সব

চিদানন্দরসে ধায় ॥২৯॥
 

রায় রামানন্দের প্রীতি

প্রকৃত সহজশ্রীকৃষ্ণভজন

করে রামানন্দ রায় ।

সুবৈধ সাধনেএ জড দেহেতে

সুযুক্ত বৈরাগ্য ভায় ॥৩০॥
 
বিশুদ্ধ দেহেতেব্রজে কৃষ্ণ ভজে

মহাপ্রভু-কৃপা পাঞা ।

নাটকাভিনয়েদেবদাসীশিক্ষা

সঙ্গদোষশূন্য হঞা ॥৩১॥
 

প্রীতি-শিক্ষায় অধিকার কাহার ?

রামানন্দ বিনাতাহে অধিকার

কেহ নাহি পায় আর ।

পরস্ত্রী-দর্শনস্পর্শন, সেবন

বুদ্ধি হৃদে আছে যার ।

পীরিতি শিক্ষায়জানিবে নিশ্চয়

নাহি তার অধিকার ॥৩২॥
 

স্ত্রীপুরুষবুদ্ধি থাকিতে প্রীতিসাধন অসম্ভব

কভু এ সংসারেস্ত্রী-পুং-ব্যবহারে

না হয় পীরিতি-ধন ।

চর্ম্মসুখ যতঅনিত্য নিয়ত

নহে নিত্য সংঘটন ॥৩৩॥
 
গোপীভাব ধরি’চিদ্ধর্ম্ম আচরি’

পীরিতি সাধিবে যেই ।

স্ত্রী-পুং-ব্যবহারনাহিক তাহার

ভিতরে গোপিনী সেই ॥৩৪॥
 
বাহিরে সজ্জনধর্ম্ম-আচরণ

আমরণ বৈধাচার ।

অন্তরেতে গোপীচিত্তে কৃষ্ণ সেবে

কেবল পীরিতি তার ॥৩৫॥
 
‘যঃ কৌমার হর’ইত্যাদি কবিতা

কেবল উপমাস্থল ।

নায়ক-নায়িকাচিৎস্বরূপ হঞা

কৃষ্ণ ভজে সুনির্ম্মল ॥৩৬॥
 

জড়েতে এই ভাব আরোপ, নরক—কলির ছলনা

কেহ যদি বলে ইহা আরোপ চিন্তায় ।

পরপুরুষেতে কৃষ্ণভজন উপায় ॥৩৭॥


চৈতন্য আজ্ঞায় আমি একথা না মানি ।

জড়েতে এরূপ বুদ্ধি নরক বলি’ মানি ॥৩৮॥

জড়দেহে চিদারোপ, সঙ্গ তুচ্ছ অতি ।

তাহে কৃষ্ণভাব আনা, সমূহ দুর্ম্মতি ॥৩৯॥

কলির ছলনা এই জানিহ নিশ্চয় ।

ইহাতে বৈষ্ণব-ধর্ম্ম অধঃপথে যায় ॥৪০॥

সুকৃতি পুরুষ মাত্র উপমা বুঝিয়া ।

স্বীয় অপ্রাকৃতদেহে কৃষ্ণ ভজে গিয়া ॥৪১॥

চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি আদি মহাজন ।

পূর্ব্ববুদ্ধি দূরে রাখি’ করিল ভজন ॥৪২॥

সে সবার শেষ বাক্য চিন্ময়ী পীরিতি ।

আছে তবু নাহি বুঝে দুষ্কৃতির রীতি ॥৪৩॥

রঘুনাথ, এ বিষয়ে করহ বিচার ।

তোমা হেন ভক্ত প্রচারিবে সদাচার ॥৪৪॥

এ বিষয় একবার প্রভুকে জানাঞা ।

চিত্ত দৃঢ় করি’ লও, দৃঢ় কর হিয়া” ॥৪৫॥

তবে রঘুনাথ শ্রীমৎ প্রভুপদে গিয়া ।

ঠারে ঠোরে জিজ্ঞাসিল বিনীত হইয়া ॥৪৬॥

প্রভু তারে আজ্ঞা দিল আমার সম্মুখে ।

রঘুনাথ আজ্ঞা পেয়ে ভজে মনসুখে ॥৪৭॥

শ্রীরঘুনাথ-প্রতি শ্রীমন্মহাপ্রভুর আজ্ঞা ঃ—

“গ্রাম্য কথা না শুনিবে, গ্রাম্য বার্ত্তা না কহিবে ।

ভাল না খাইবে, আর ভাল না পরিবে ॥৪৮॥

অমানী, মানদ, কৃষ্ণনাম সদা লবে ।

ব্রজে রাধাকৃষ্ণ-সেবা মানসে করিবে” ॥৪৯॥

এই আজ্ঞা পাঞা রঘু বুঝিল তখন ।

পীরিতি না হয় কভু জড়েতে সাধন ॥৫০॥

মানসেতে সিদ্ধদেহ করিয়া ভাবন ।

সেই দেহে রাধানাথের করিবে সেবন ॥৫১॥

অমানী মানদ ভাবে অকিঞ্চন হঞা ।

বৃক্ষ হেন সহিষ্ণুতা আপনে করিয়া ॥৫২॥

বাহ্যদেহে কৃষ্ণনাম সর্ব্বকাল গায় ।

অন্তর্দেহে থাকে রাধাকৃষ্ণের সেবায় ॥৫৩॥

ভাল খাওয়া, ভাল পরা পরিত্যাগ করি’ ।

প্রাণবৃত্তি দ্বারা জড়দেহযাত্রা ধরি’ ॥৫৪॥

মর্কট-বৈরাগী

এই জড়দেহে রাধাকৃষ্ণ বুদ্ধ্যারোপ ।

মর্কট বৈরাগী করে সর্ব্বধর্ম্ম লোপ ॥৫৫॥

প্রভু বলিয়াছেন, “মর্কট বৈরাগী সে জন ।

বৈরাগীর প্রায় থাকি’ করে প্রকৃতি-সম্ভাষণ” ॥৫৬॥

বিশুদ্ধ বৈরাগী

বিশুদ্ধ বৈরাগী করে নাম সঙ্কীর্ত্তন ।

মাগিয়া খাইয়া করে জীবন-যাপন ॥৫৭॥

বৈরাগী হইয়া যেবা করে পরাপেক্ষা ।

কার্য্যসিদ্ধি নহে, কৃষ্ণ করে উপেক্ষা ॥৫৮॥

বৈরাগী হইয়া করে জিহ্বার লালস ।

পরমার্থ যায়, আর হয় রসের বশ ॥৫৯॥

বৈরাগী করিবে সদা নাম-সঙ্কীর্ত্তন ।

শাক-পত্র-ফল-মূলে উদর ভরণ ॥৬০॥

জিহ্বার লালসে যেই সমাজে বেড়ায় ।

শিশ্নোদরপরায়ণ কৃষ্ণ নাহি পায় ॥৬১॥

 


 

← ১৫। শ্রীনবদ্বীপে পূর্ব্বাহ্ণ-লীলা ১৭। ভক্তভেদে আচারভেদ →

 

সূচীপত্র:
১। মঙ্গলাচরণ
২। গ্রন্থরচনা
৩। প্রথম প্রণাম
৪। গৌরস্য গুরুতা
৫। বিবর্ত্তবিলাসসেবা
৬। জীব-গতি
৭। সকলের পক্ষে নাম
৮। কুটীনাটি ছাড়
৯। যুক্তবৈরাগ্য
১০। জাতিকুল
১১। নবদ্বীপ-দীপক
১২। বৈষ্ণব-মহিমা
১৩। শ্রীগৌরদর্শনের ব্যাকুলতা
১৪। বিপরীত বিবর্ত্ত
১৫। শ্রীনবদ্বীপে পূর্ব্বাহ্ণ-লীলা
১৬। পীরিতি কিরূপ ?
১৭। ভক্তভেদে আচারভেদ
১৮। শ্রীএকাদশী
১৯। নামরহস্যপটল
২০। নাম-মহিমা
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥