 |
আমাদের শ্রীগুরুপরম্পরা :
|
“শ্রীচৈতন্য-সারস্বত মঠে সূর্যাস্ত কখনই হয় না” :
|
|
|
|
|
|
শ্রীশ্রীপ্রেমবিবর্ত্ত
১৬। পীরিতি কিরূপ ?
শ্রীরঘুনাথদাস গোস্বামীর প্রশ্ন
|
একদিন রঘুনাথ স্বরূপে জিজ্ঞাসে ।
“কি বস্তু পীরিতি ? মোরে শিখাও আভাসে ॥১॥
বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস যে প্রীতি বর্ণিল ।
সে প্রীতি বুঝিতে মোর শক্তি না হইল ॥২॥
তাঁহাদের বাক্যে বাহ্যে বুঝে যে পীরিতি ।
সে কেবল স্ত্রীপুরুষের প্রণয়ের রীতি ॥৩॥
সে কেমনে পরমার্থ-মধ্যে গণ্য হয় ।
প্রাকৃত কামকে কেন অপ্রাকৃত কয় ॥৪॥
মহাপ্রভু তোমার সঙ্গে সেই সব গান ।
করেন সর্ব্বদা, তার না পাই সন্ধান ॥৫॥
প্রভু তব হস্তে মোরে করিল সমর্পণ ।
আজ্ঞা কৈল, ‘শিখাও একে নিগূঢ তত্ত্বধন’ ॥৬॥
|
কৃপা করি’ প্রীতিতত্ত্ব মোরে দেহ বুঝাইয়া ।
কৃতার্থ হইব মুঞি সংশয় ত্যজিয়া” ॥৭॥
|
স্বরূপ বলিল, “ভাই রঘুনাথদাস ।
নিভৃতে তোমারে তত্ত্ব করিব প্রকাশ ॥৮॥
আমি কিবা রামানন্দ অথবা পণ্ডিত ।
কেহ না বুঝিবে তত্ত্ব প্রভুর উদিত ॥৯॥
তবে যদি গৌরচন্দ্র জিহ্বায় বসিয়া ।
বলাইবে নিজতত্ত্ব সকৃপ হইয়া ॥১০॥
তখনই জানিবে হৈল সুসত্য প্রকাশ ।
শুনিয়া আনন্দ পাবে রঘুনাথদাস ॥১১॥
|
চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি | কর্ণামৃত রায়ের গীতি
|
এসব অমূল্য শাস্ত্র জান । |
এসবে নাহিক কাম | এসব প্রেমের ধাম
|
অপ্রাকৃত তাহাতে বিধান ॥১২॥ |
|
স্ত্রী-পুরুষ-বিবরণ | যে কিছু তঁহি বর্ণন
|
সে সব উপমা মাত্র সার । |
প্রাকৃত-কাম-বর্ণন | তাহে কৃষ্ণ-অদর্শন
|
অপ্রাকৃত করহ বিচার ॥১৩॥ |
|
কি পুরুষ, কিবা নারী, | এ-তত্ত্ব বুঝিতে নারি
|
জড়দেহে করে রসরঙ্গ । |
সে গুরু কৃষ্ণের ভাণে | শুদ্ধ-রীতি নাহি
জানে
|
তাহার ভজন মায়ারঙ্গ ॥১৪॥ |
|
কৃষ্ণপ্রেম সুনির্ম্মল | যেন শুদ্ধ গঙ্গাজল
|
সেই প্রেমা অমৃতের সিন্ধু । |
নির্ম্মল সে অনুরাগ | নাহি তাহে জড়দাগ
|
শুক্লবস্ত্র শূন্যমসীবিন্দু ॥১৫॥ |
|
শুদ্ধপ্রেম সুখসিন্ধু | পাই তার এক বিন্দু
|
সেই বিন্দু জগৎ ডুবায় । |
জড়দেহে করি’ প্রীতি | কেবল কামের রীতি
|
শুদ্ধ দেহ না হয় উদয় ॥১৬॥ |
|
দূরে শুদ্ধ প্রেমবন্ধ | কপট প্রেমেতে অন্ধ
|
সেই প্রেমে কৃষ্ণ নাহি পায় । |
তবে যে করে ক্রন্দন | স্বসৌভাগ্য
প্রখ্যাপন
|
করে ইহা, জানিহ নিশ্চয় ॥১৭॥ |
|
কৃষ্ণপ্রেম যার হয় | তার বিভাব চিন্ময়
|
অনুভাব দেহেতে প্রকাশ । |
সাত্ত্বিকাদি ব্যভিচারী | চিন্ময়-স্বরূপ
ধরি’
|
চিৎস্বরূপে করয়ে বিলাস ॥১৮॥ |
|
ধন্য সেই লীলাশুক | কৃষ্ণ তারে হয়ে সম্মুখ
|
দিল ব্রজের অপ্রাকৃত রস । |
ছাড়িল এদেহ-রঙ্গ | প্রাকৃতালম্বন-ভঙ্গ
|
তাহে কৃষ্ণ পরম সন্তোষ ॥১৯॥ |
|
বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস | ছাড়ি’ পূর্ব্ব রসাভাস
|
অপ্রাকৃত-রসলাভ কৈল । |
পূর্ব্বে ছিল তুচ্ছ রস | তাহা ছাড়ি’
প্রেমবশ
|
হঞা, কৃষ্ণভজন লভিল ॥২০॥ |
|
তুচ্ছ রসে মাতোয়ার | না পায় কৃষ্ণরস-সার
|
নহে বংশীবদনালম্বন । |
জড় দেহে সাজে সাজ | মাথায় তার পড়ে বাজ
|
প্রাণকীটের করয়ে ধারণ ॥২১॥ |
|
সেই তুচ্ছ রস ত্যজি’ | শ্রীনন্দনন্দন ভজি’
|
দেখে কৃষ্ণ শ্রীবংশীবদন । |
নিজে গোপীদেহ পায় | ব্রজবনে বেগে যায়
|
পূর্ব্ব সঙ্গ করয় ত্যজন ॥২২॥ |
|
‘ন প্রেমগন্ধোঽস্তি দরাপি মে হরৌ
ক্রন্দামি সৌভাগ্যভরং প্রকাশিতুম্ ।
বংশীবিলাস্যাননলোকনং বিনা
বিভর্ম্মি যৎ প্রাণপতঙ্গকান্ বৃথা’ ॥২৩॥
|
ব্রজগোপী ব্যতীত পীরিতি বুঝে না
|
পীরিতি পীরিতি পীরিতি বলে পীরিতি বুঝিল কে ? ।
যে জন পীরিতি বুঝিতে পারে ব্রজগোপী হয় সে ॥২৪॥
পীরিতি বলিয়া তিনটী আঁখর বিদিত ভুবন-মাঝে ।
যাহাতে পশিল সেই সে মজিল কি তার কলঙ্কলাজে ॥২৫॥
ব্রজগোপী হঞা চিদ্দেহ স্মরিয়া জড়ের সম্বন্ধ ছাড়ে ।
বিষয়ে আশ্রয়ে শুদ্ধ-আলম্বন পরকীয়-রস বাড়ে ॥২৬॥
ব্রজ বিনা কোথাও নাহি পরকীয়-ভাব ।
বৈকুণ্ঠ-লক্ষ্মীতে তার সদা অসদ্ভাব ॥২৭॥
|
সংসারে যতেক | পুরুষ, রমণী
|
আলম্বন-দোষে সদা । |
রক্তমাংসদেহে | আরোপ করিতে
|
নারকী হয় সর্ব্বদা ॥২৮॥ |
|
অতএব তারা | সহজ-সাধনে
|
কৃষ্ণকৃপা যবে পায় । |
জড়দেহগন্ধ | ছাড়িয়া সে সব
|
চিদানন্দরসে ধায় ॥২৯॥ |
|
প্রকৃত সহজ | শ্রীকৃষ্ণভজন
|
করে রামানন্দ রায় । |
সুবৈধ সাধনে | এ জড দেহেতে
|
সুযুক্ত বৈরাগ্য ভায় ॥৩০॥ |
|
বিশুদ্ধ দেহেতে | ব্রজে কৃষ্ণ ভজে
|
মহাপ্রভু-কৃপা পাঞা । |
নাটকাভিনয়ে | দেবদাসীশিক্ষা
|
সঙ্গদোষশূন্য হঞা ॥৩১॥ |
|
প্রীতি-শিক্ষায় অধিকার কাহার ?
|
রামানন্দ বিনা | তাহে অধিকার
|
কেহ নাহি পায় আর । |
পরস্ত্রী-দর্শন | স্পর্শন, সেবন
|
বুদ্ধি হৃদে আছে যার । |
পীরিতি শিক্ষায় | জানিবে নিশ্চয়
|
নাহি তার অধিকার ॥৩২॥ |
|
স্ত্রীপুরুষবুদ্ধি থাকিতে প্রীতিসাধন অসম্ভব
|
কভু এ সংসারে | স্ত্রী-পুং-ব্যবহারে
|
না হয় পীরিতি-ধন । |
চর্ম্মসুখ যত | অনিত্য নিয়ত
|
নহে নিত্য সংঘটন ॥৩৩॥ |
|
গোপীভাব ধরি’ | চিদ্ধর্ম্ম আচরি’
|
পীরিতি সাধিবে যেই । |
স্ত্রী-পুং-ব্যবহার | নাহিক তাহার
|
ভিতরে গোপিনী সেই ॥৩৪॥ |
|
বাহিরে সজ্জন | ধর্ম্ম-আচরণ
|
আমরণ বৈধাচার । |
অন্তরেতে গোপী | চিত্তে কৃষ্ণ সেবে
|
কেবল পীরিতি তার ॥৩৫॥ |
|
‘যঃ কৌমার হর’ | ইত্যাদি কবিতা
|
কেবল উপমাস্থল । |
নায়ক-নায়িকা | চিৎস্বরূপ হঞা
|
কৃষ্ণ ভজে সুনির্ম্মল ॥৩৬॥ |
|
জড়েতে এই ভাব আরোপ, নরক—কলির ছলনা
|
কেহ যদি বলে ইহা আরোপ চিন্তায় ।
পরপুরুষেতে কৃষ্ণভজন উপায় ॥৩৭॥
চৈতন্য আজ্ঞায় আমি একথা না মানি ।
জড়েতে এরূপ বুদ্ধি নরক বলি’ মানি ॥৩৮॥
জড়দেহে চিদারোপ, সঙ্গ তুচ্ছ অতি ।
তাহে কৃষ্ণভাব আনা, সমূহ দুর্ম্মতি ॥৩৯॥
কলির ছলনা এই জানিহ নিশ্চয় ।
ইহাতে বৈষ্ণব-ধর্ম্ম অধঃপথে যায় ॥৪০॥
সুকৃতি পুরুষ মাত্র উপমা বুঝিয়া ।
স্বীয় অপ্রাকৃতদেহে কৃষ্ণ ভজে গিয়া ॥৪১॥
চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি আদি মহাজন ।
পূর্ব্ববুদ্ধি দূরে রাখি’ করিল ভজন ॥৪২॥
সে সবার শেষ বাক্য চিন্ময়ী পীরিতি ।
আছে তবু নাহি বুঝে দুষ্কৃতির রীতি ॥৪৩॥
রঘুনাথ, এ বিষয়ে করহ বিচার ।
তোমা হেন ভক্ত প্রচারিবে সদাচার ॥৪৪॥
এ বিষয় একবার প্রভুকে জানাঞা ।
চিত্ত দৃঢ় করি’ লও, দৃঢ় কর হিয়া” ॥৪৫॥
তবে রঘুনাথ শ্রীমৎ প্রভুপদে গিয়া ।
ঠারে ঠোরে জিজ্ঞাসিল বিনীত হইয়া ॥৪৬॥
প্রভু তারে আজ্ঞা দিল আমার সম্মুখে ।
রঘুনাথ আজ্ঞা পেয়ে ভজে মনসুখে ॥৪৭॥
|
শ্রীরঘুনাথ-প্রতি শ্রীমন্মহাপ্রভুর আজ্ঞা ঃ—
|
“গ্রাম্য কথা না শুনিবে, গ্রাম্য বার্ত্তা না কহিবে ।
ভাল না খাইবে, আর ভাল না পরিবে ॥৪৮॥
অমানী, মানদ, কৃষ্ণনাম সদা লবে ।
ব্রজে রাধাকৃষ্ণ-সেবা মানসে করিবে” ॥৪৯॥
এই আজ্ঞা পাঞা রঘু বুঝিল তখন ।
পীরিতি না হয় কভু জড়েতে সাধন ॥৫০॥
মানসেতে সিদ্ধদেহ করিয়া ভাবন ।
সেই দেহে রাধানাথের করিবে সেবন ॥৫১॥
অমানী মানদ ভাবে অকিঞ্চন হঞা ।
বৃক্ষ হেন সহিষ্ণুতা আপনে করিয়া ॥৫২॥
বাহ্যদেহে কৃষ্ণনাম সর্ব্বকাল গায় ।
অন্তর্দেহে থাকে রাধাকৃষ্ণের সেবায় ॥৫৩॥
ভাল খাওয়া, ভাল পরা পরিত্যাগ করি’ ।
প্রাণবৃত্তি দ্বারা জড়দেহযাত্রা ধরি’ ॥৫৪॥
|
এই জড়দেহে রাধাকৃষ্ণ বুদ্ধ্যারোপ ।
মর্কট বৈরাগী করে সর্ব্বধর্ম্ম লোপ ॥৫৫॥
প্রভু বলিয়াছেন, “মর্কট বৈরাগী সে জন ।
বৈরাগীর প্রায় থাকি’ করে প্রকৃতি-সম্ভাষণ” ॥৫৬॥
|
বিশুদ্ধ বৈরাগী করে নাম সঙ্কীর্ত্তন ।
মাগিয়া খাইয়া করে জীবন-যাপন ॥৫৭॥
বৈরাগী হইয়া যেবা করে পরাপেক্ষা ।
কার্য্যসিদ্ধি নহে, কৃষ্ণ করে উপেক্ষা ॥৫৮॥
বৈরাগী হইয়া করে জিহ্বার লালস ।
পরমার্থ যায়, আর হয় রসের বশ ॥৫৯॥
বৈরাগী করিবে সদা নাম-সঙ্কীর্ত্তন ।
শাক-পত্র-ফল-মূলে উদর ভরণ ॥৬০॥
জিহ্বার লালসে যেই সমাজে বেড়ায় ।
শিশ্নোদরপরায়ণ কৃষ্ণ নাহি পায় ॥৬১॥
|
|
সূচীপত্র:
১। মঙ্গলাচরণ
২। গ্রন্থরচনা
৩। প্রথম প্রণাম
৪। গৌরস্য গুরুতা
৫। বিবর্ত্তবিলাসসেবা
৬। জীব-গতি
৭। সকলের পক্ষে নাম
৮। কুটীনাটি ছাড়
৯। যুক্তবৈরাগ্য
১০। জাতিকুল
১১। নবদ্বীপ-দীপক
১২। বৈষ্ণব-মহিমা
১৩। শ্রীগৌরদর্শনের
ব্যাকুলতা
১৪। বিপরীত বিবর্ত্ত
১৫। শ্রীনবদ্বীপে
পূর্ব্বাহ্ণ-লীলা
১৬। পীরিতি কিরূপ ?
১৭। ভক্তভেদে আচারভেদ
১৮। শ্রীএকাদশী
১৯। নামরহস্যপটল
২০। নাম-মহিমা
|
|
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে ।
পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥
|