| ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
|
||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
চতুর্থোঽধ্যায়ঃ জ্ঞানযোগ
শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ কহিলেন) অহম্ (আমি) অব্যয়ম্ (অব্যয়) ইমম্ (এই) যোগম্ (এই) যোগম্ (নিষ্কাম কর্ম্মসাধ্য জ্ঞানযোগের কথা) বিবস্বতে (সূর্য্যকে) প্রোক্তবান্ (পুরাকালে বলিয়াছিলাম), বিবস্বান্ (সূর্য্য) মনবে (স্বীয় পুত্ত্র বৈবস্বত মনুকে) প্রাহ (বলেন) মনুঃ (মনু) ইক্ষ্বাকবে (স্বপুত্ত্র ইক্ষ্বাকুকে) অব্রবীৎ (বলিয়াছিলেন) ॥১॥ শ্রীভগবান্ কহিলেন—আমি পূর্ব্বে সূর্য্যকে এই অব্যয় নিষ্কাম-কর্ম্মসাধ্য জ্ঞানযোগের কথা বলিয়াছিলাম । সূর্য্য তাহাই নিজ পুত্ত্র বৈবস্বত মনুকে বলেন, এবং মনুও তাহাই স্বীয় পুত্ত্র ইক্ষ্বাকুকে বলিয়াছিলেন ॥১॥
এবং (এইরূপে) পরম্পরা-প্রাপ্তম্ (পরম্পরাক্রমে প্রাপ্ত) ইমং (এই যোগ) রাজর্ষয়ঃ (রাজর্ষিগণ) বিদুঃ (অবগত হন), [হে] পরন্তপ ! (হে শত্রু দমন অর্জ্জুন !) সঃ যোগঃ (সেই জ্ঞান যোগ) মহতা কালেন (বহুকাল গত হওয়ায়) ইহ (বর্ত্তমানে) নষ্টঃ (নষ্টপ্রায় হইয়াছে) ॥২॥ হে পরন্তপ ! এইরূপে পরম্পরাপ্রাপ্ত এই জ্ঞানযোগ নিমি, জনক প্রভৃতি রাজর্ষিগণ অবগত হইয়াছিলেন । সেই যোগ অনেক কাল গত হওয়ায় আপাততঃ নষ্টপ্রায় হইয়াছে ॥২॥
[ত্বম্] (তুমি) মে (আমার) ভক্তঃ সখা চ (ভক্ত ও সখা) ইতি [হেতোঃ] (এইজন্য) অয়ং সঃ এব (এই সেই) পুরাতনঃ (পুরাতন) যোগঃ (যোগ) অদ্য (আজ) ময়া (আমা কর্ত্তৃক) তে (তোমার নিকট) প্রোক্তঃ (কথিত হইল), হি (যেহেতু) এতৎ (ইহা) উত্তমম্ রহস্যম্ (অতি গোপনীয়) ॥৩॥ সেই সনাতন যোগ অদ্য আমি তোমাকে বলিলাম, যেহেতু তুমি আমার ভক্ত ও সখা, অতএব এই উত্তম যোগ অত্যন্ত গোপনীয় হইলেও তোমাকে আমি উপদেশ করিলাম ॥৩॥
অর্জ্জুনঃ উবাচ (অর্জ্জুন বলিলেন) ভবতঃ (আপনার) জন্ম (জন্ম) অপরং (ইদানীন্তন) বিবস্বতঃ (সূর্য্যের) জন্ম (জন্ম) পরম্ (পূর্ব্বে হইয়াছে) [তস্মাৎ] (অতএব) ত্বম্ (তুমি) আদৌ (পুরাকালে) [ইমং যোগং] (এই যোগ) প্রোক্তবান্ (বলিয়াছিলে) ইতি (এই যে কথা) এতৎ (ইহা) [অহং] (আমি) কথম্ (কিরূপে) বিজানীয়াং (বুঝিতে পারি ?) ॥৪॥ অর্জ্জুন বলিলেন—বিবস্বান্ (সূর্য্য) পূর্ব্বকালে জন্মিয়াছিলেন এবং তুমি ইদানীন্তন জন্মগ্রহণ করিয়াছ । সুতরাং তুমিই যে পূর্ব্বে সূর্য্যকে এই যোগ উপদেশ করিয়াছিলে এ কথা কি প্রকারে বিশ্বাস করা যায়? ॥৪॥
শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ কহিলেন) [হে] পরন্তপ অর্জ্জুন ! (হে শত্রুতাপন অর্জ্জুন !) মে তব চ (আমার ও তোমার) বহূনি (বহু) জন্মানি (জন্ম) অতীতানি (অতীত হইয়াছে) ; অহং (আমি) তানি (সেই) সর্ব্বাণি (সমস্তই) বেদ (অবগত আছি), ত্বং ((তুমি কিন্তু) [তানি] (সে সকল) ন বেত্থ (জান না) ॥৫॥ শ্রীভগবান্ কহিলেন—হে শত্রুতাপন অর্জ্জুন ! আমার এবং তোমার অনেক জন্ম বিগত হইয়াছে । পরমেশ্বরত্ব হেতু আমি সে সমস্ত স্মরণ করিতে পারি । তুমি অণুচৈতন্য জীব, সে সব স্মরণ করিতে পার না ॥৫॥
[অহম্] (আমি) অজঃ (জন্মরহিত) সন্ অপি (হইয়াও) অব্যয়াত্মা (অনশ্বর শরীর) [সন্ অপি] (হইয়াও) ভূতানাম্ (প্রাণিগণের) ঈশ্বরঃ (ঈশ্বর) সন্ অপি (হইয়াও) স্বাম্ প্রকৃতিম্ (স্বকীয় সচ্চিদানন্দ স্বরূপকে) অধিষ্ঠায় (অধিষ্ঠান করিয়া) আত্মমায়য়া (যোগমায়া বিস্তারে) সম্ভবামি (দেব-মনুষ্য-তির্য্যক্ প্রভৃতি লোকে আবির্ভূত হই) ॥৬॥ আমি জন্ম-মৃত্যু-রহিত নিত্য-বিগ্রহ এবং সমস্ত জীবের নিয়ামক হইয়াও নিজ স্বরূপে অধিষ্ঠিত থাকিয়া স্বেচ্ছায় যোগমায়া বিস্তার-পূর্ব্বক জগতে আবির্ভূত হই ॥৬॥
[হে] ভারত ! (হে অর্জ্জুন !) যদা যদা হি (যে যে সময়েই) ধর্ম্মস্য (ধর্ম্মের) গ্লানিঃ (গ্লানি) অধর্ম্মস্য [চ] (এবং অধর্ম্মের) অভ্যুত্থানম্ (প্রাদুর্ভাব) ভবতি (হয়), তদা (তখনই) আত্মানং (নিজের স্বরূপকে) অহম্ (আমি) সৃজামি (সৃষ্ট দেহের মত প্রদর্শন করাই ) ॥৭॥ হে ভারত ! যখন যখন ধর্ম্মের গ্লানি ও অধর্ম্মের অভ্যুত্থান হয়, তখনই আমি সৃষ্ট দেহবৎ আত্মপ্রকাশ করি, অর্থাৎ আবির্ভূত হই ॥৭॥
সাধূনাং (সাধুগণের) পরিত্রাণায় (পরিত্রাণের জন্য) [তথা] (এবং) দুষ্কৃতাম্ (দুষ্কৃতগণের) বিনাশায় (বিনাশের হেতু) ধর্ম্মসংস্থাপনার্থায় চ (এবং মদীয় ধ্যান-যজন-পরিচর্য্যা-সঙ্কীর্ত্তনরূপ ধর্ম্ম সম্যক্রূপে স্থাপন করিবার নিমিত্ত) [অহং] (আমি) যুগে যুগে (প্রতি যুগে ) সম্ভবামি (আবির্ভূত হই) ॥৮॥ সাধুগণের পরিত্রাণ, দুষ্কৃতকারিগণের বিনাশ ও ধর্ম্মকে সম্যক্ প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য আমি যুগে যুগে আবির্ভূত হই ॥৮॥
[হে] অর্জ্জুন ! (হে অর্জ্জুন !) যঃ (যিনি) মে (আমার) এবং (এইরূপ) দিব্যম্ (স্বেচ্ছাকৃত ও অপ্রাকৃত) জন্ম কর্ম্ম চ (জন্ম ও কর্ম্ম) তত্ত্বতঃ (পূর্ব্বোক্তমত তত্ত্ব বিচারক্রমে) বেত্তি (অবগত হন), সঃ (তিনি) দেহং (বর্ত্তমান দেহ) ত্যক্ত্বা (ত্যাগ করিয়া) পুনঃ (পুনর্ব্বার) জন্ম (জন্ম) ন এতি (গ্রহণ করেন না), [কিন্তু] মাম্ এতি (আমাকে প্রাপ্ত হন) ॥৯॥ হে অর্জ্জুন ! যিনি আমার এইরূপ স্বেচ্ছাকৃত অপ্রাকৃত জন্ম ও কর্ম্ম যথার্থভাবে অবগত হন, তিনি নিজের এই বর্ত্তমান দেহটী পরিত্যাগ করিয়া পুনরায় আর জন্মগ্রহণ করেন না কিন্তু আমাকেই প্রাপ্ত হন, অর্থাৎ আমার চিচ্ছক্তি প্রকাশরূপ হ্লাদিনী-শক্তির বশীভূত হইয়া আমার নিত্যসেবা প্রাপ্ত হন ॥৯॥
বীতরাগভয়ক্রোধাঃ (জড় বিষয়ে প্রীতি, ভয় ও ক্রোধশূন্য হইয়া) মম্ময়াঃ (আমার বিষয় শ্রবণ, কীর্ত্তন ও স্মরণে নিবিষ্ট চিত্ত) মাম্ উপাশ্রিতাঃ (আমার আশ্রিত) বহবঃ (বহু ব্যক্তি) জ্ঞানতপসা (মদীয় জ্ঞানের ও মৎসম্বন্ধীয় তপস্যা দ্বারা) পূতাঃ [সন্তঃ] (নির্ম্মল হইয়া) মদ্ভাবম্ (আমাতে ভাব-ভক্তি) আগতাঃ (লাভ করিয়াছেন) ॥১০॥ জড়বিষয়ে প্রীতি, ভয় ও ক্রোধশূন্য, আমার বিষয়ে শ্রবণ, কীর্ত্তন ও স্মরণে নিবিষ্টচিত্ত ও আমারই আশ্রিত বহু ব্যক্তি মৎসম্বন্ধীয় জ্ঞান ও তপস্যায় বিশুদ্ধ হইয়া আমার পবিত্র প্রেমলাভ করিয়াছেন ॥১০॥
যে (যাহারা) যথা (যে প্রকারে) মাং (আমাকে) প্রপদ্যন্তে (ভজনা করে), অহম্ (আমি) তান্ (তাহাদিগকে) তথা এব (সেই প্রকারেই) ভজামি (ভজন ফল দান করি) । [হে] পার্থ ! (হে অর্জ্জুন !) সর্ব্বশঃ মনুষ্যাঃ (জ্ঞানি-কর্ম্মি-যোগি-দেবতান্তর-ভজনকারী সকল মনুষ্যই) মম বর্ত্ম (আমার পথের) অনুবর্ত্তন্তে (অনুসরণ করে) ॥১১॥ যে ব্যক্তি আমার প্রতি যেভাবে প্রপত্তি স্বীকার করেন, আমি তাহাকে সেইভাবেই ভজন করি । সকল মতেরই চরম উদ্দেশ্য স্বরূপ আমি সকলেরই প্রাপ্য । সমস্ত মনুষ্যই আমার বিবিধ বর্ত্মের অনুসরণ করে ॥১১॥
ইহ (এই মনুষ্য লোকে) কর্ম্মণাং (কর্ম্ম সমূহের) সিদ্ধিং (সাফল্য) কাঙ্ক্ষন্তঃ (কামনাকারী ব্যক্তিগণ) দেবতাঃ (ইন্দ্রাদি দেবতাগণের) যজন্তে (ভজনা করিয়া থাকে), হি (যেহেতু) মানুষে লোকে (মনুষ্য লোকে) কর্ম্মজা (কর্ম্ম জন্য) সিদ্ধিঃ (স্বর্গাদি ফল) ক্ষিপ্রং (শ্রীঘ্রই) ভবতি (হইয়া থাকে) ॥১২॥ এই মনুষ্যলোকে কর্ম্মসমূহের সহজে সাফল্য কামনাশীল ব্যক্তিগণ ইন্দ্রাদি দেবতাগণকে ভজনা করেন । তদ্দ্বারা মনুষ্যলোকে কর্ম্মজ ফল স্বর্গাদি লাভ অতি শীঘ্রই সংঘটিত হইয়া থাকে ॥১২॥
ময়া (আমা কর্ত্তৃক) গুণকর্ম্মবিভাগশঃ (সত্ত্বাদি গুণ ও শম দমাদি কর্ম্মের বিভাগ অনুসারে) চাতুর্ব্বর্ণ্যং (ব্রাহ্মণাদি চারিটী বর্ণ) সৃষ্টং (সৃষ্ট হইয়াছে) । তস্য (সেই বর্ণ ধর্ম্মের ও বর্ণ সকলের) কর্ত্তারম্ অপি (স্রষ্টা হইলেও) মাং (আমাকে) অকর্ত্তারম্ (বস্তুতঃ গুণাতীত স্বরূপ বলিয়া অস্রষ্টা) অব্যয়ম্ (ও নির্ব্বিকার বলিয়া) বিদ্ধি (জানিবে) ॥১৩॥ সত্ত্বাদিগুণ ও শমদমাদি কর্ম্মের বিভাগ অনুসারে ব্রাহ্মণাদি বর্ণচতুষ্টয় আমিই সৃজন করিয়াছি । জগতে আমি বই আর কেহ কর্ত্তা নাই । কিন্তু সেই বর্ণধর্ম্মের কর্ত্তা হইলেও আমাকে বস্তুতঃ গুণাতীত স্বরূপ বলিয়া অকর্ত্তা ও অব্যয় বলিয়া জানিতে হইবে ॥১৩॥
কর্ম্মাণি (কর্ম্ম সকল) [জীবমিব] (জীবের ন্যায়) মাং (আমাকে) ন লিম্পন্তি (লিপ্ত করিতে পারে না), মে (আমার) কর্ম্মফলে (কর্ম্মফল স্বর্গাদিতেও) স্পৃহা (স্পৃহা) ন [অস্তি] (নাই), ইতি (এইরূপ) যঃ (যিনি) মাং (আমাকে) অভিজানাতি (সাম্যক্ জানিতে পারেন) সঃ (তিনি) কর্ম্মভিঃ (কর্ম্মের দ্বারা) ন বধ্যতে (বদ্ধ হন না) ॥১৪॥ জীবের অদৃষ্ট বশতঃ যে কর্ম্মতত্ত্ব আমি সৃষ্টি করিয়াছি, তাহা আমাকে লিপ্ত করিতে পারে না । কর্ম্মফলেও আমার স্পৃহা নাই, (যেহেতু অতি তুচ্ছ কর্ম্মফল আমি যে ষড়ৈশ্বর্য্যপূর্ণ ভগবান্ আমার পক্ষে নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর ।) জীবের কর্ম্মমার্গ ও আমার স্বতন্ত্রতা বিচার পূর্ব্বক যিনি আমার অব্যয়তত্ত্ব অবগত হইতে পারেন, তিনি কখনই কর্ম্ম দ্বারা বদ্ধ হন না । শুদ্ধভক্তি আচরণ করতঃ আমাকেই লাভ করেন ॥১৪॥
এবং (এইরূপ) জ্ঞাত্বা (জানিয়া) পূর্ব্বৈঃ (পূর্ব্ব পূর্ব্ব) মুমুক্ষুভিঃ অপি (মুক্তিকামিগণও) কর্ম্ম (মদর্পিত কর্ম্ম) কৃতং (করিয়াছেন) । তস্মাৎ (অতএব) ত্বং (তুমি) পূর্ব্বৈঃ (প্রাচীন জনকাদি মহাজন কর্ত্তৃক) পূর্ব্বতরং কৃতম্ (পূর্ব্বে অনুষ্ঠিত) কর্ম্ম এব (নিষ্কাম কর্ম্মযোগই) কুরু (অবলম্বন কর) ॥১৫॥ পূর্ব্ব পূর্ব্ব মুমুক্ষুগণ এই তত্ত্ব অবগত হইয়া সকাম কর্ম্ম পরিত্যাগ পূর্ব্বক নিষ্কাম মদর্পিত কর্ম্মানুষ্ঠান করিয়াছেন । অতএব তুমিও পূর্ব্ব পূর্ব্ব মহাজন অনুষ্ঠিত নিষ্কাম কর্ম্মযোগ অবলম্বন কর ॥১৫॥
কিং কর্ম্ম (কর্ম্ম কি ?) কিম্ অকর্ম্ম (অকর্ম্মই বা কি ?) ইতি অত্র (এই তত্ত্ব নিরূপণে) কবয়ঃ অপি (জ্ঞানিগণও) মোহিতাঃ [ভবন্তি] (মোহ প্রাপ্ত হন), [অতঃ] (অতএব) যৎ জ্ঞাত্বা (যাহা জানিয়া) অশুভাৎ (অমঙ্গলপূর্ণ সংসার হইতে) মোক্ষ্যসে (মুক্তি লাভ করিতে পারিবে) তৎ কর্ম্ম (সেই কর্ম্ম ও অকর্ম্ম) তে (তোমাকে) প্রবক্ষ্যামি (বলিব) ॥১৬॥ কাহাকে কর্ম্ম ও কাহাকে অকর্ম্ম বলে তাহা স্থিরীকরণ সম্বন্ধে জ্ঞানিগণও মোহপ্রাপ্ত হইয়া থাকেন । অতএব যাহা অবগত হইয়া তুমি অমঙ্গলপূর্ণ সংসার হইতে মুক্তিলাভ করিবে সেই কর্ম্ম ও অকর্ম্ম সম্বন্ধে তোমাকে উপদেশ করিতেছি ॥১৬॥
কর্ম্মণঃ অপি (বেদবিহিত কর্ম্মেরও) বোদ্ধব্যং (জানিবার বিষয়) বিকর্ম্মণঃ চ (শাস্ত্র নিষিদ্ধ কর্ম্মের সম্বন্ধেও) বোদ্ধব্যং (জানিবার বিষয়) অকর্ম্মণঃ চ (এবং কর্ম্মের অকরণ অর্থাৎ সন্ন্যাস সম্বন্ধেও) বোদ্ধব্যং (জানিবার বিষয়) [অস্তি] (আছে) । হি (যেহেতু) কর্ম্মণঃ (কর্ম্ম, বিকর্ম্ম ও অকর্ম্মের) গতিঃ (যথার্থ তত্ত্ব) গহনা (অতিশয় দুর্গম) ॥১৭॥ বেদবিহিত কর্ম্মেরও জানিবার বিষয় আছে, শাস্ত্র নিষিদ্ধ কর্ম্মের সম্বন্ধেও জানিবার বিষয় আছে, এবং কর্ম্মের সন্ন্যাস সম্বন্ধেও জানিবার বিষয় আছে । কর্ত্তব্যাচরণই ‘কর্ম্ম’, নিষিদ্ধাচরণই ‘বিকর্ম্ম’, এবং কর্ম্মের অকরণ বা সন্ন্যাসই ‘অকর্ম্ম’, ইহাদের নিগূঢ় তত্ত্ব নিরূপণ সুকঠিন ॥১৭॥
যঃ (যিনি) কর্ম্মণি (শুদ্ধান্তঃকরণ জ্ঞানিকর্ত্তৃক অনুষ্ঠীয়মান নিষ্কাম কর্ম্ম যোগে) অকর্ম্ম (বন্ধকত্ব নাই বলিয়া উহা কর্ম্ম নয় এইরূপ) অকর্ম্মণি চ (এবং অশুদ্ধান্তঃ করণ সন্ন্যাসী কর্ত্তৃক কর্ম্মের অকরণে) কর্ম্ম (দুর্গতি প্রাপক কর্ম্মবন্ধন) পশ্যেৎ (দর্শন করেন) সঃ (তিনিই) মনুষ্যেষু (মনুষ্যদিগের মধ্যে) বুদ্ধিমান্ (বিবেকী), সঃ (তিনিই) যুক্তঃ (যোগী) কৃৎস্নকর্ম্মকৃৎ (এবং সম্পূর্ণ কর্ম্মের অনুষ্ঠাতা) ॥১৮॥ যিনি শুদ্ধান্তঃকরণ জ্ঞানীর নিষ্কাম কর্ম্মানুষ্ঠানে বন্ধকত্ব নাই সুতরাং উহা কর্ম্ম নয় এইরূপ জানেন ; এবং অশুদ্ধান্তঃকরণ সন্ন্যাসীর কর্ম্মত্যাগে দুর্গতি প্রাপক কর্ম্মবন্ধন উপলব্ধি করেন, তিনিই মনুষ্যদিগের মধ্যে বুদ্ধিমান্ যোগী এবং সম্পূর্ণ কর্ম্মানুষ্ঠাতা ॥১৮॥
যস্য (যাঁহার) সর্ব্বে (সমস্ত) সমারম্ভাঃ (কর্ম্ম) কামসঙ্কল্পবর্জ্জিতাঃ (ফল কামনা রহিত) জ্ঞানাগ্নিদগ্ধকর্ম্মাণং (তিনি জ্ঞানরূপ অগ্নিতে বিহিত ও নিষিদ্ধ কর্ম্মসমূহ দগ্ধ করিয়াছেন) তম্ (তাঁহাকে) বুধাঃ (সুধীগণ) পণ্ডিতঃ (পণ্ডিত) আহুঃ (বলেন) ॥১৯॥ যাঁহার সমুদয় কর্ম্মাচরণ ফলকামনা শূন্য, জ্ঞানাগ্নিতে বিহিত ও নিষিদ্ধ কর্ম্মসমূহ দগ্ধকারী তাঁহাকে বিবেকিগণ ‘পণ্ডিত’ বলেন ॥১৯॥
[যঃ] (যিনি) কর্ম্মফলাসঙ্গং (কর্ম্ম ফলের আসক্তি) ত্যক্তা (ত্যাগ করিয়া) নিত্যতৃপ্তঃ (নিত্য নিজানন্দে তৃপ্ত) নিরাশ্রয়ঃ (এবং যোগক্ষেম নিমিত্ত আশ্রয় নিরপেক্ষ) সঃ (তিনি) কর্ম্মণি (সমস্ত কর্ম্মে) অভিপ্রবৃত্তঃ অপি ( সম্যক্ প্রবৃত্ত হইলেও) কিঞ্চিৎ এব (কিছুই) ন করোতি (করেন না) ॥২০॥ যিনি কর্ম্মফলের আসক্তি পরিত্যাগ পূর্ব্বক নিত্য নিজানন্দে পরিতৃপ্ত এবং যোগ ও ক্ষেমের নিমিত্ত আশ্রয় নিরপেক্ষ, তিনি সমস্ত কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইয়াও কিছুই করেন না অর্থাৎ সেই সমস্ত কর্ম্মফলে আবদ্ধ হন না ॥২০॥
[সঃ] (তিনি) নিরাশীঃ (নিষ্কাম) যতচিত্তাত্মা (সংযত চিত্ত ও শরীর) ত্যক্তসর্ব্বপরিগ্রহঃ (এবং সর্ব্ব প্রকার পরিগ্রহ ত্যাগী) [সন্] (হইয়া) কেবলং (কেবল) শারীরং (শরীর রক্ষার্থ অসৎপ্রতিগ্রহাদি) কর্ম্ম (কর্ম্ম) কুর্ব্বন্ [অপি] (করিয়াও) কিল্বষম্ (পাপ) ন আপ্নোতি (গ্রস্ত হন না) ॥২১॥ তিনি ফলাশা ও সমস্ত পরিগ্রহ অর্থাৎ সংগ্রহচেষ্টাতিশয্য ত্যাগ করতঃ স্বীয় শরীর ও চিত্তকে বুদ্ধির অধীন রাখিয়া যদি কেবলমাত্র শরীর যাত্রা-নির্ব্বাহের জন্য অসৎ প্রতিগ্রহাদি কর্ম্ম করিয়াও থাকেন, তাহাতে তাঁহার সেই কর্ম্ম-জনিত পাপ বা পূণ্য কিছুই হয় না ॥২১॥
যদৃচ্ছালাভসন্তুষ্টঃ (অনায়াসে প্রাপ্ত বস্তুতে সন্তষ্ট), দ্বন্দ্বাতীতঃ (শীতোষ্ণ সুখদুঃখাদি সহনশীল), বিমৎসরঃ (অন্যের প্রতি দ্বেষ শূন্য), সিদ্ধৌ অসিদ্ধৌ চ (এবং কার্য্যের সিদ্ধি ও অসিদ্ধি বিষয়ে) সমঃ (হর্ষ ও বিষাদরহিত) [জনঃ] (ব্যক্তি) [কর্ম্ম] কৃত্বা অপি (কর্ম্ম করিয়াও) ন নিবধ্যতে (বদ্ধ হন না) ॥২২॥ তিনি অনায়াসে যাহা প্রাপ্ত হন, তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকেন, সুখ-দুঃখ, রাগ-দ্বেষ ইত্যাদি দ্বন্দ্বের বশীভূত হন না, মাৎসর্য্যকে দূর করেন ; কার্য্যের সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে হর্ষ বা বিষাদযুক্ত হন না অর্থাৎ তুল্য জ্ঞান করেন । অতএব যে কর্ম্মই করুন তাহাতে নিজে বদ্ধ হন না ॥২২॥
গতসঙ্গস্য (আসক্তি রহিত), মুক্তস্য (মুক্ত), জ্ঞানাবস্থিতচেতসঃ (জ্ঞানে অবস্থিত চিত্ত), যজ্ঞায় (এবং যজ্ঞের অর্থাৎ পরমেশ্বরের প্রীত্যর্থে) কর্ম্ম আচরতঃ (কর্ম্ম আচরণকারী পুরুষের) সমগ্রং (সমুদয়) [কর্ম্ম] (কর্ম্ম) প্রবিলীয়তে (প্রকৃষ্টরূপে লয়প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ ফলজনক হয় না) ॥২৩॥ আসক্তি রহিত, মুক্ত ও জ্ঞানে অবস্থিত চিত্ত পুরুষের যজ্ঞের জন্য যে কর্ম্ম আচরিত হয়, তাঁহার আচরিত সেই সমস্ত কর্ম্ম প্রকৃষ্টরূপে লয় পাইয়া যায় । কর্ম্মমীমাংসকগণ যাহাকে ‘অপূর্ব্ব’ বলেন, নিষ্কাম-কর্ম্মযোগীর কর্ম্মসকল সেই অপূর্ব্বতা লাভ করে না ॥২৩॥
অর্পণং (স্রুক্স্রুবাদি) ব্রহ্ম (ব্রহ্ম স্বরূপ) [অর্প্যমাণম্] (অর্প্যমাণ) হবিঃ (ঘৃতাদিও) ব্রহ্ম (ব্রহ্মস্বরূপ) ব্রহ্মণা (হবন কর্ত্ত্রা] (ব্রহ্মস্বরূপ হোতৃপুরুষ কর্ত্তৃক) ব্রহ্মাগ্নৌ (ব্রহ্মস্বরূপ অগ্নিতে) হুতম্ (হোমও) [ব্রহ্ম] (ব্রহ্মস্বরূপ) [ভবতি] (হয়) ; [এবং বিবেকবতা] (এইরূপ বিচারযুক্ত) তেন (সেই পুরুষের) ব্রহ্মকর্ম্মসমাধিনা (ব্রহ্মাত্মক কর্ম্মে চিত্তের একাগ্রতা নিবন্ধন) ব্রহ্ম এব (ব্রহ্মই) গন্তব্যম্ (লভ্য হয়) ॥২৪॥ যজ্ঞের মূল তত্ত্ব বলিতেছেন—স্রুক্স্রুবাদি, অর্প্যমাণ ঘৃতাদি হোমীয় অগ্নি, আহুতি প্রদানকারী ব্রাহ্মণ এবং হোমক্রিয়া বা তৎফল এই সমস্তই ব্রহ্মস্বরূপ হইয়া থাকে । এইরূপ বিচারযুক্ত পুরুষের ব্রহ্মাত্মক কর্ম্মে চিত্তের একাগ্রতা নিবন্ধন তিনি ব্রহ্মকেই লাভ করিয়া থাকেন ॥২৪॥
অপরে (অপর) যোগিনঃ (কর্ম্মযোগিগণ) দৈবম্ যজ্ঞং এব (ইন্দ্রাদিদেবোদ্দেশ্যক যজ্ঞেরই) পর্য্যুপাসতে (উপাসনা করেন), অপরে (জ্ঞানযোগিগণ) ব্রহ্মাগ্নৌ (তৎপদার্থ পরমাত্মরূপ অগ্নিতে) যজ্ঞং (হবিঃ স্থানীয় ত্বংপদার্থ জীবাত্মাকে) যজ্ঞেন এব (প্রণবরূপ মন্ত্র দ্বারাই) উপজুহ্বতি (আহুতি প্রদান করেন) ॥২৫॥ অপর কর্ম্মযোগিগণ ইন্দ্র বরুণাদি দেবগণের পূজারূপ দৈবযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন । অন্য জ্ঞানযোগিগণ তৎপদার্থ পরমাত্মরূপ অগ্নিতে হবিঃ স্থানীয় ত্বংপদার্থ জীবাত্মাকে প্রণবরূপ মন্ত্র দ্বারাই হোম করেন ॥২৫॥
অন্যে (নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারিগণ) সংযমাগ্নিষু (ইন্দ্রিয়সংযমরূপ অগ্নিতে অর্থাৎ সংযত মনে) শ্রোত্রাদীনি (শ্রোত্র চক্ষুরাদি) ইন্দ্রিয়াণি (ইন্দ্রিয় সকলকে) জুহ্বতি (হোম করেন), অন্যে (অপর ব্রহ্মচারিগণ) ইন্দ্রিয়াগ্নিষু (ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে) শব্দাদীন্ (শব্দাদি) বিষয়ান্ (বিষয় সমূহকে) জুহ্বতি (হোম করেন) ॥২৬॥ অপর নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারিগণ মনঃ সংযমরূপ অগ্নিতে শ্রোত্রাদি ইন্দ্রিয় সকলকে হোম করেন । স্বধর্ম্মপরায়ণ গৃহিসকল শব্দাদি বিষয়সমূহকে ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে হোম করেন ॥২৬॥
অপরে (শুদ্ধত্বংপদার্থবিজ্ঞগণ) জ্ঞানদীপিতে (জ্ঞানদ্বারা প্রদীপ্ত) আত্মসংযমযোগাগ্নৌ (ত্বং পদার্থের শুদ্বিরূপ অগ্নিতে) সর্ব্বাণি (সমস্ত) ইন্দ্রিয়কর্ম্মাণি (ইন্দ্রিয় ও তাহাদের কর্ম্ম শ্রবণ দর্শনাদি) প্রাণকর্ম্মাণি চ (এবং দশপ্রাণ ও তাহাদের কার্য্য) জুহ্বতি (হোম করিয়া থাকেন) ॥২৭॥ প্রত্যগাত্মার অনুসন্ধানকারী কৈবল্যবাদী পাতঞ্জলাদি যোগিসকল জ্ঞান দ্বারা ত্বংপদার্থের শুদ্ধিরূপ অগ্নিতে সমস্ত ইন্দ্রিয়গণ ও তাহাদের কর্ম্ম শ্রবণ দর্শনাদি এবং দশপ্রাণও তাহাদের কার্য্য সমুদয়ই হোম করিয়া থাকেন ॥২৭॥
[কেচিৎ] (কেহ কেহ) দ্রব্যযজ্ঞাঃ (দ্রব্যদানরূপ যজ্ঞ করেন) [কেচিৎ] (কেহ কেহ) তপোযজ্ঞাঃ (কৃচ্ছ্র চান্দ্রয়ণাদিরূপ যজ্ঞ করেন) তথা অপরে (এবং অপর কেহ কেহ) যোগযজ্ঞাঃ (অষ্টাঙ্গ যোগরূপ যজ্ঞ করেন) [কেচন] (আবার কেহ কেহ) স্বাধ্যায়-জ্ঞান-যজ্ঞাশ্চ (বা বেদপাঠ ও বেদার্থজ্ঞানরূপ যজ্ঞকারী) [এতে সর্ব্বে] (ইহারা সকলেই) যতয়ঃ (যত্নশীল) সংশিতব্রতাঃ (ও তীক্ষ্ণব্রতকারী) ॥২৮॥ কেহ কেহ দ্রব্যদানরূপ যজ্ঞশীল, কেহ কেহ কৃচ্ছ্র চান্দ্রায়ণাদিরূপ যজ্ঞশীল, কেহ কেহ অষ্টাঙ্গযোগরূপ যজ্ঞশীল এবং অপর কেহ বা বেদপাঠ ও বেদার্থ জ্ঞানরূপ যজ্ঞকারী । ইহারা সকলেই যত্নশীল ও তীক্ষ্ণব্রতকারী ॥২৮॥
অপরে (অপর কেহ) অপানে (অধোবৃত্তি বায়ুতে) প্রাণং (উর্দ্ধবৃত্তি বায়ুকে) জুহ্বতি (পূরককালে একীভূত করেন) তথা (সেইরূপ) প্রাণে অপানং (রেচককালে অপান বায়ুকে প্রাণ বায়ুতে) জুহ্বতি (হোম করেন) ; প্রাণাপানগতী (কুম্ভককালে প্রাণ ও অপানের গতিকে) রুদ্ধা (নিরোধ পূর্ব্বক) প্রাণায়ামপরায়ণাঃ (প্রাণায়াম পরায়ণ) [ভবন্তি] (হইয়া থাকেন) । অপরে (অপর ইন্দ্রিয়-জয়কামিগণ) নিয়তাহারাঃ (আহার সংকোচ পূর্ব্বক) প্রাণেষু (প্রাণ বায়ুতে) প্রাণান্ (ইন্দ্রিয় সকলকে) জুহ্বতি (হোম করেন) ॥২৯॥ অপর কেহ কেহ অধোবৃত্তি বায়ুতে উর্দ্ধবৃত্তি-বায়ুকে পূরককালে একীভূত করেন, সেইরূপ রেচককালে অপান বায়ুকে প্রাণবায়ুতে হোম করেন ; এবং কুম্ভককালে প্রাণ ও অপানের গতি নিরোধপূর্ব্বক প্রাণায়াম পরায়ণ হইয়া থাকেন । অপর ইন্দ্রিয় জয়কামিগণ আহার সঙ্কোচ অভ্যাস করিয়া প্রাণবায়ুতে ইন্দ্রিয় সকলকে হোম করেন ॥২৯॥
এতে সর্ব্বে অপি (ইহারা সকলেই) যজ্ঞবিদঃ (যজ্ঞতত্ত্ববিৎ) যজ্ঞক্ষয়িতকল্মষাঃ (যজ্ঞের দ্বারা ক্ষীণপাপ) যজ্ঞশিষ্টামৃতভুজঃ (যজ্ঞাবশিষ্ট অমৃত অর্থাৎ ভোগ, ঐশ্বর্য্য ও সিদ্ধি প্রভৃতি ভোগ করেন) ; সনাতনম্ (এবং জ্ঞান দ্বারা সনাতন) ব্রহ্ম (ব্রহ্মকেই) যান্তি (লাভ করেন) ॥৩০॥ ইহারা সকলেই যজ্ঞতত্ত্ববেত্তা, যজ্ঞের দ্বারা ক্ষীণ পাপ হইয়া যজ্ঞাবশিষ্ট অমৃত অর্থাৎ ভোগ, ঐশ্বর্য্য ও সিদ্ধি প্রভৃতি ভোগ করতঃ অবশেষে পূর্ব্বোক্ত সনাতন ব্রহ্মকেই লাভ করেন ॥৩০॥
[হে] কুরুসত্তম ! (হে কুরুশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুন !) অযজ্ঞস্য (যজ্ঞরহিত ব্যক্তির) অয়ং লোকঃ [অপি] (এই অল্পসুখবিশিষ্ট মনুষ্যলোকও) ন [অস্তি] (নাই) অন্যঃ [লোকঃ] (অপর স্বর্গলোক) কুতঃ [প্রাপ্তব্যঃ] (কিরূপে প্রাপ্তি সম্ভব হইবে ? ) ॥৩১॥ হে কুরুশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুন ! যজ্ঞানুষ্ঠানবিহীন ব্যক্তির পক্ষে ইহলোক প্রাপ্তিই সম্ভব হয় না, তখন ইহাদের পরলোক প্রাপ্তি কিরূপে সম্ভব হইবে ? ॥৩১॥
ব্রহ্মণঃ মুখে (বেদরূপ মুখে) এবং (এই প্রকার) বহুবিধাঃ (বহুবিধ) যজ্ঞাঃ (যজ্ঞ) বিততাঃ (স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে), [ত্বং] (তুমি) তান্ সর্ব্বান্ (সেই সকল যজ্ঞকেই) কর্ম্মজান্ (বাক্য-মন-কায় কর্ম্মজনিত বলিয়া) বিদ্ধি (জানিবে), এবং (এইরূপ) জ্ঞাত্বা (জানিয়া) বিমোক্ষ্যসে (কর্ম্ম-বন্ধন হইতে মুক্তি লাভ করিবে) ॥৩২॥ এই সমস্ত প্রকার যজ্ঞই বেদোক্ত বা বেদানুগত শাস্ত্রোক্ত ; ইহারা সকলেই বাক্য-মন-কায়-কর্ম্ম-জনিত, অতএব কর্ম্মজ । এইরূপে কর্ম্মতত্ত্ব বিচার করিতে পারিলে কর্ম্মবন্ধন হইতে মুক্তিলাভ করিতে পারিবে ॥৩২॥
[হে] পরন্তপ পার্থ ! (হে শত্রুতাপন অর্জ্জুন !) [তেষু অপি] (সেই যজ্ঞগুলির মধ্যেও) দ্রব্যময়াৎ (ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্ম হবিঃ ইত্যাদিরূপ দ্রব্যময়) যজ্ঞাৎ (যজ্ঞ হইতে) জ্ঞানযজ্ঞঃ (ব্রহ্মাগ্নাবপরে ইত্যাদি শ্লোকোক্ত জ্ঞানযজ্ঞ) শ্রেয়ান্ (শ্রেষ্ঠ) । [যতঃ] (যেহেতু) জ্ঞানে [সতি] (জ্ঞানের উদয় হইলে) সর্ব্বং কর্ম্ম (সমুদয় কর্ম্ম) অখিলং [সৎ] (অব্যর্থ হইয়া) পরিসমাপ্যতে (সমাপ্ত হয় অর্থাৎ জ্ঞানের অনন্তর কর্ম্ম থাকে না) ॥৩৩॥ হে শত্রুতাপন অর্জ্জুন ! সেই সমস্ত যজ্ঞগুলির মধ্যেও ‘ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্ম হবিঃ’ ইত্যাদিরূপ দ্রব্যময় যজ্ঞ হইতে ‘ব্রহ্মাগ্নাবপরে’ ইত্যাদি শ্লোকোক্ত জ্ঞানযজ্ঞ অত্যন্ত শ্রেষ্ঠ । যেহেতু সমস্ত কর্ম্মই জ্ঞানে পরিসমাপ্তি লাভ করে ॥৩৩॥
প্রণিপাতেন (তত্ত্বদর্শী গুরুকে দণ্ডবৎ নমস্কার), পরিপ্রশ্নেন (সঙ্গত প্রশ্ন), সেবয়া (ও অকপট পরিচর্য্যা দ্বারা) তৎ (পূর্ব্বোক্ত সেই জ্ঞানের কথা) বিদ্ধি (জানিতে হইবে) ; জ্ঞানিনঃ (শাস্ত্রজ্ঞানী) তত্ত্বদর্শিনঃ (পরব্রহ্ম বিষয়ে অপরোক্ষানুভূতি সম্পন্ন মহাত্মগণ) তে (তোমাকে) জ্ঞানং (জ্ঞান) উপদেক্ষ্যন্তি (উপদেশ করিবেন) ॥৩৪॥ তুমি তত্ত্বদর্শী গুরুকে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত, সঙ্গত প্রশ্ন ও অকৃত্রিম সেবা করতঃ সন্তুষ্ট করিয়া পূর্ব্বোক্ত সেই জ্ঞানের কথা জানিতে পারিবে । শাস্ত্রজ্ঞানে সুনিপুণ ও পরব্রহ্ম বিষয়ে সাক্ষাৎ অনুভূতি সম্পন্ন মহাপুরুষগণ তোমাকে তত্ত্বজ্ঞান উপদেশ করিবেন ॥৩৪॥
[হে] পাণ্ডব ! (হে পাণ্ডব !) যৎ [জ্ঞানং] (আত্মা দেহাদি হইতে ভিন্ন এইরূপ যে জ্ঞান) জ্ঞাত্বা (লাভ করিয়া) পুনঃ (পুনরায়) এবং (এইরূপ) মোহম্ (মোহ) ন যাস্যসি (প্রাপ্ত হইবে না), যেন [মোহবিগমেন] (নিত্যসিদ্ধ আত্মজ্ঞান লাভে মোহ নষ্ট হইলে) অশেষাণি ভূতানি (মনুষ্য তির্য্যক্ প্রভৃতি ভূত সমুদয়) আত্মনি (জীবাত্মায়) [উপাধিত্বেন] (উপাধিরূপে অবস্থিত) [পৃথক্] দ্রক্ষ্যসি (পৃথক্ দর্শন করিবে), অথো (অনন্তর) ময়ি (আমাতে) [কার্য্যত্বেন স্থিতানি] (কার্য্যরূপে অবস্থিত) [দ্রক্ষ্যসি] (দর্শন করিবে) ॥৩৫॥ হে পাণ্ডব ! গুরূপদিষ্ট সেই তত্ত্বজ্ঞান লাভ করিলে আর তোমাকে এরূপ মোহ আশ্রয় করিবে না । সেই তত্ত্বজ্ঞান দ্বারা তুমি জানিতে পারিবে যে, মনুষ্য তির্য্যগাদি ভূতসকল এক জীবাত্মারূপ তত্ত্বে অবস্থিত ; উপাধি দ্বারা তাহাদের জড়ীয় তারতম্য ঘটিয়াছে এবং এ সমুদয়ই পরম কারণরূপ আমাতে কার্য্যরূপে অবস্থিতি করে ॥৩৫॥
চেৎ (যদি) সর্ব্বেভ্যঃ অপি পাপেভ্যঃ (সমস্ত পাপী হইতেও পাপকৃত্তমঃ (অধিক পাপিষ্ঠ) অসি (হও), [তথাপি] সর্ব্বং (সমস্ত) বৃজিনং (পাপ ও দুঃখ) জ্ঞানপ্লবেন এব (জ্ঞানরূপ ভেলা দ্বারা) সন্তরিষ্যসি (সমুত্তীর্ণ হইবে) ॥৩৬॥ যদিও তুমি অত্যন্ত পাপ আচরণ করিয়া থাক, তাহা হইলেও জ্ঞানপোতে আরোহণ পূর্ব্বক সমস্ত দুঃখ সমুদ্র পার হইয়া যাইবে ॥৩৬॥
[হে] অর্জ্জুন ! (হে অর্জ্জুন !) যথা (যেরূপ) সমিদ্ধঃ (সম্যক্রূপে প্রজ্জ্বলিত) অগ্নিঃ (অগ্নি) এধাংসি (কাষ্ঠ সমূহকে) ভস্মসাৎ (ভস্মসাৎ) কুরুতে (করে), তথা (সেইরূপ) জ্ঞানাগ্নিঃ (জ্ঞানরূপ অগ্নি) সর্ব্বকর্ম্মাণি (বর্ত্তমান দেহারম্ভক প্রারব্ধ ভিন্ন সমুদয় কর্ম্মকে) ভস্মসাৎ (ভস্মসাৎ) কুরুতে (করে) ॥৩৭॥ প্রবলরূপে জ্বলিত অগ্নি যেমত কাষ্ঠাদিকে ভস্মসাৎ করে, হে অর্জ্জুন ! জ্ঞানাগ্নিও সেইরূপ সমস্ত কর্ম্মকে দগ্ধ করিয়া থাকে ॥৩৭॥
ইহ (তপস্যাদির মধ্যে) জ্ঞানেন সদৃশং (জ্ঞানের তুল্য) পবিত্রম্ (পবিত্র) [কিমপি] ন হি বিদ্যতে (আর কিছুই নাই) তৎ (সেই জ্ঞান) যোগসংসিদ্ধঃ (নিষ্কাম কর্ম্মযোগে সমাক্ সিদ্ধ ব্যক্তি) কালেন (বহুকাল পরে) আত্মনি (আত্মাতে) স্বয়ং (স্বয়ং প্রাপ্তরূপে) বিন্দতি (লাভ করেন) ॥৩৮॥ পূর্ব্বোক্ত তপস্যাদির মধ্যে জ্ঞানের সমান পবিত্র পদার্থ আর কিছুই নাই । নিষ্কাম কর্ম্মযোগের সাধনায় সুসিদ্ধ মানব দীর্ঘকাল পরে সেই জ্ঞান স্বীয় আত্মাতে স্বয়ং প্রাপ্তরূপে লাভ করিয়া থাকেন ॥৩৮॥
শ্রদ্ধাবান্ (নিষ্কাম কর্ম্মানুষ্ঠান দ্বারা অন্তঃকরণ শুদ্ধি হইলেই জ্ঞান হয়, এই শাস্ত্রীয় অর্থে আস্তিক্য বুদ্ধিমান্), তৎপরঃ (নিষ্কাম কর্ম্মানুষ্ঠানরত) সংযতেন্দ্রিয়ঃ (এবং জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি) জ্ঞানং (জ্ঞান) লভতে (লাভ করেন) । জ্ঞানং (জ্ঞান) লব্ধ্বা (লাভ করিয়া) অচিরেণ (অতিশ্রীঘ্র) পরাং শান্তিম্ (সংসার ক্ষয়রূপ পরাশান্তি) অধিগচ্ছতি (লাভ করেন) ॥৩৯॥ নিষ্কাম কর্ম্মানুষ্ঠান দ্বারা অন্তঃকরণ শুদ্ধ হইলে পর জ্ঞান হয় । এই শাস্ত্র তাৎপর্য্যে আস্তিক্য বুদ্ধিমান্, শ্রদ্ধা-সহকারে নিষ্কাম-কর্ম্মযোগ অনুষ্ঠানরত এবং জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিই সেই জ্ঞান লাভ করেন । তিনি এই জ্ঞান লাভ করিয়া শ্রীঘ্রই সংসারক্ষয়রূপ পরাশান্তি লাভ করিয়া থাকেন ॥৩৯॥
অজ্ঞঃ (পশ্বাদিবৎমূঢ়) অশ্রদ্দধানঃ (শ্রাস্ত্রজ্ঞান থাকিলেও নানামতবাদদৃষ্টে অবিশ্বস্ত) সংশয়াত্মা চ (এবং শ্রদ্ধা থাকিলেও আমার এই বিষয় সিদ্ধি হইবে কিনা এইরূপ সন্দেহাকুলচিত্ত ব্যক্তি) বিনশ্যতি (বিনষ্ট হয় অর্থাৎ কল্যাণ হইতে বিচ্যুত হয়) । সংশয়াত্মনঃ (সংশয়িতচিত্ত মানবের) অয়ং লোকঃ (এই মনুষ্যলোক) ন [অস্তি] (নাই) ন চ পরঃ (পরলোকও নাই) ন চ সুখং অস্তি (বৈষয়িক সুখও নাই) ॥৪০॥ শাস্ত্রজ্ঞানহীন পশ্বাদির মত মূঢ়, শাস্ত্রজ্ঞান থাকিলেও নানা মতবাদ দেখিয়া শাস্ত্রার্থে বিশ্বাসশূন্য, এবং শ্রদ্ধা থাকিলেও ‘আমার এই বিষয় সিদ্ধ হইবে কিনা’ এইরূপ সন্দেহাক্রান্ত মতি মানব কখনও মঙ্গললাভ করিতে পারে না । সংশয়াত্মার ইহলোকে বা পরলোকে কোথাও সুখ লাভ হয় না, কারণ সংশয়রূপ দুঃখই তাহার শান্তি নাশ করে ॥৪০॥
[হে] ধনঞ্জয় ! (হে ধনঞ্জয় !) যোগসংন্যস্তকর্ম্মাণং (নিষ্কাম কর্ম্মযোগের অনন্তরই যিনি সন্ন্যাস বিধিতে কর্ম্মত্যাগ করিয়াছেন), জ্ঞানসংছিন্ন-সংশয়ম্ (তদনন্তর জ্ঞানাভ্যাস দ্বারা সংশয় নাশ করিয়াছেন) আত্মবন্তং (এবং আত্মস্বরূপ উপলব্ধি করিয়াছেন) কর্ম্মাণি (কর্ম্মসমূহ) [তম্] (তাঁহাকে) ন নিবধ্নন্তি (বদ্ধ করিতে পারে না) ॥৪১॥ হে ধনঞ্জয় ! যিনি নিষ্কাম কর্ম্মযোগের দ্বারা কর্ম্ম সন্ন্যাস করেন, তারপর জ্ঞানাভ্যাস দ্বারা সংশয় সমূহ নাশ করেন এবং আত্মার চিন্ময়স্বরূপ অবগত হন, তাঁহাকে কোন কর্ম্মই আবদ্ধ করিতে পারে না ॥৪১॥
[হে] ভারত ! (হে অর্জ্জুন !) তস্মাৎ (অতএব) আত্মনঃ (তোমার) অজ্ঞানসম্ভূতং (অজ্ঞান হইতে উদ্ভূত) হৃৎস্থং (হৃদয়স্থিত) এনং (এই) সংশয়ং (সংশয়কে) জ্ঞানাসিনা (জ্ঞানরূপ খড়্গ দ্বারা) ছিত্ত্বা (ছেদন করিয়া) যোগম্ (নিষ্কাম কর্ম্মযোগ) আতিষ্ঠ (আশ্রয় কর) উত্তিষ্ঠ [চ] (এবং [যুদ্ধার্থ] উত্থিত হও) ॥৪২॥ হে ভারত ! অতএব তোমার অজ্ঞান সম্ভূত হৃদয়স্থিত এই সংশয়কে জ্ঞানখড়্গ দ্বারা ছেদন কর, এবং নিষ্কাম কর্ম্মযোগ আশ্রয় পূর্ব্বক (যুদ্ধার্থ) উত্থিত হও ॥৪২॥
ইতি চতুর্থ অধ্যায়ের অন্বয় সমাপ্ত ॥ ইতি চতুর্থ অধ্যায়ের বঙ্গানুবাদ সমাপ্ত ॥
—···—
|
সূচিপত্র: মঙ্গলাচরণম্ গ্রন্থ-পরিচয় প্রকাশকের নিবেদন ১ সৈন্য-দর্শন ২ সাংখ্যযোগ ৩ কর্ম্মযোগ ৪ জ্ঞানযোগ ৫ কর্ম্মসন্ন্যাসযোগ ৬ ধ্যানযোগ ৭ জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ ৮ তারকব্রহ্মযোগ ৯ রাজগুহ্যযোগ ১০ বিভূতিযোগ ১১ বিশ্বরূপ-দর্শনযোগ ১২ ভক্তিযোগ ১৩ প্রকৃতিপুরুষ-বিবেক-যোগ ১৪ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ ১৫ পুরুষোত্তমযোগ ১৬ দৈবাসুরসম্পদ্-বিভাগ যোগ ১৭ শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ ১৮ মোক্ষযোগ গীতামাহাত্ম্যম্ |
|||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥ | ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
© Sri Chaitanya Saraswat Math, Nabadwip, West Bengal, India. For any enquiries please visit our contact page. |