| ||||||||||||||||||||||||||||
|
||||||||||||||||||||||||||||
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
চতুর্দ্দশোঽধ্যায়ঃ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ
শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ বলিলেন) জ্ঞানানাং (জ্ঞান সাধন সমূহের মধ্যে) পরং (অতি) উত্তমম্ (উত্তম) জ্ঞানম্ (উপদেশ) ভূয়ঃ (পুনর্ব্বার) প্রবক্ষ্যামি (বলিব), যৎ (যাহা) জ্ঞাত্বা (অবগত হইয়া) সর্ব্বে (সকল) মুনয়ঃ (মুনিগণ) ইতঃ (এই দেহবন্ধন হইতে) পরাং (পরম) সিদ্ধিং (সিদ্ধি) গতাঃ (লাভ করিয়াছেন) ॥১॥ শ্রীভগবান্ কহিলেন—অতঃপর জ্ঞানসাধন সমূহের মধ্যে অতি উত্তম জ্ঞান পুনরায় তোমাকে বলিব, যাহা জানিয়া মুনিসমূহ এই জগৎ হইতে পরমসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন ॥১॥
ইদং (এই) জ্ঞানম্ (জ্ঞান) উপাশ্রিত্য (আশ্রয় করিয়া) [জীবঃ] (জীব) মম (আমার) সাধর্ম্ম্যম্ (সারূপ্য ধর্ম্ম) আগতাঃ [সন্তঃ] (প্রাপ্ত হইয়া) সর্গে অপি (বিশ্ব সৃষ্টিকালেও) ন উপ জায়ন্তে (উৎপন্ন হয় না) প্রলয়ে চ (এবং প্রলয়কালেও) ন ব্যথন্তি (বিনাশ ব্যথা অনুভব করে না) ॥২॥ এই জ্ঞানকে আশ্রয় করিয়া (বহুলাংশে) আমার সহিত সমধর্ম্মী জীব বিশ্বসৃষ্টিকালেও উৎপন্ন হয় না এবং প্রলয়েও বিনাশ ব্যথা অনুভব করে না ॥২॥
[হে] ভারত ! (হে অর্জ্জুন !) মহৎব্রহ্ম (দেশ বা কালের দ্বারা অবিভক্ত ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতি) মম (আমার) যোনিঃ (গর্ভাধানের স্থান), তস্মিন্ (তাহাতেই) গর্ব্ভং [তটস্থাশক্তি জাত] (জীবরূপ বীজ) অহং (আমি) দধামি (অর্পণ করি), ততঃ (তাহা হইতে) সর্ব্বভূতানাং (সকল জীবের) সম্ভবঃ (উৎপত্তি) ভবতি (হয়) ॥৩॥ হে ভারত ! প্রধান সংজ্ঞক প্রকৃতি আমার গর্ভাধানের স্থান, তাহাতেই আমি (তটস্থাশক্তি জীবরূপ) বীজ নিক্ষেপ করি । তাহা হইতে ব্রহ্মাদি সমস্ত জীবের জন্ম হয় ॥৩॥
[হে] কৌন্তেয় ! (হে কুন্তীপুত্ত্র !) সর্ব্বযোনিষু (দেব মনুষ্যাদি সকল যোনিতে) যাঃ (যে সকল) মূর্ত্তয়ঃ (শরীর) সম্ভবন্তি (উৎপন্ন হয়), তাসাং (তাহাদিগের) মহৎ ব্রহ্ম (ব্রহ্মরূপা প্রকৃতিই) যোনিঃ (প্রসূতি) অহং (আমি) বীজপ্রদঃ (গর্ভাধান কর্ত্তা) পিতা (পিতা) ॥৪॥ হে কৌন্তেয় ! দেব মনুষ্যাদি সমস্ত যোনিতে যে সকল দেহ উৎপন্ন হয়, ব্রহ্মরূপা প্রকৃতিই তাহাদের প্রসূতি এবং আমিই (কারণ-চৈতন্য) গর্ভাধানকারী পিতা ॥৪॥
[হে] মহাবাহো ! (হে মহাবীর !) প্রকৃতি সম্ভবাঃ (প্রকৃতি হইতে অভিব্যক্ত) সত্ত্বং রজঃ তমঃ ইতি (সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিনটী) গুণাঃ (গুণ) দেহে (জড়দেহ মধ্যে) অব্যয়ম্ (নির্ব্বিকার) দেহিনম্ (জীবাত্মাকে) নিবধ্নন্তি (সুখ দুঃখ মোহাদি দ্বারা সংযুক্ত করে) ॥৫॥ হে মহাবীর অর্জ্জুন ! প্রকৃতি হইতে প্রকটিত সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই গুণত্রয় জড়দেহমধ্যে অবস্থিত অব্যয় চিৎস্বরূপ জীবাত্মাকে সুখ-দুঃখ মোহদি দ্বারা বন্ধন করে ॥৫॥
[হে] অনঘ ! (হে নিস্পাপ !) তত্র (সেই গুণত্রয়ের মধ্যে) নির্ম্মলত্বাৎ (স্বচ্ছতা হেতু) প্রকাশকম্ (বস্তুর স্বরূপ প্রকাশকারী) অনাময়ম্ (ও শান্ত স্বভাব) সত্ত্বং (সত্ত্বগুণই) সুখসঙ্গেন (সুখাসক্তি) জ্ঞানসঙ্গেন চ (ও জ্ঞানাসক্তি দ্বারা) [জীবং] (জীবাত্মাকে) বধ্নাতি (আবদ্ধ করে) ॥৬॥ হে নিষ্পাপ ! সেই গুণত্রয়ের মধ্যে অপেক্ষাকৃত নির্ম্মলতা প্রযুক্ত বস্তুর স্বরূপ প্রকাশক ও শান্ত স্বভাব সত্ত্বগুণই সুখাসক্তি ও জ্ঞানাসক্তি দ্বারা দেহমধ্যে জীবাত্মাকে আবদ্ধ করে ॥৬॥
[হে] কৌন্তেয় ! (হে কুন্তীপুত্ত্র !) রজঃ (রজোগুণকে) রাগাত্মকং (ভোগানুরাগস্বরূপ) তৃষ্ণাসঙ্গসমুদ্ভবম্ (অপ্রাপ্ত বিষয়ে অভিলাষ ও প্রাপ্ত বিষয়ে আসক্তির উৎপাদক) বিদ্ধি (জানিবে), তৎ (সেই রজোগুণ) দেহিনম্ (জীবকে) কর্ম্মসঙ্গেন (কর্ম্মাসক্তি দ্বারা) নিবধ্নাতি (নিবদ্ধ করে) ॥৭॥ হে কুন্তীপুত্ত্র ! রজোগুণকে ভোগানুরাগস্বরূপ জানিবে । অপ্রাপ্ত বিষয়ে অভিলাষ ও প্রাপ্তবিষয়ে আসক্তির উৎপাদক সেই রজোগুণ কর্ম্মাসক্তি দ্বারা জীবাত্মাকে আবদ্ধ করে ॥৭॥
[হে] ভারত ! (হে অর্জ্জুন !) তমঃ তু (আর তমোগুণ) অজ্ঞানজং (অজ্ঞান হইতে জাত) সর্ব্বদেহিনাম্ (সকল জীবের) মোহনং (ভ্রান্তির জনক) বিদ্ধি (জানিবে), তৎ (সেই তমোগুণ) [জীবং] (জীবাত্মাকে) প্রমাদালস্যনিদ্রাভিঃ (অনবধান, আলস্য ও নিদ্রা দ্বারা) নিবধ্নাতি (আবদ্ধ করে) ॥৮॥ হে ভারত! আর তমোগুণ অজ্ঞান হইতে জাত ও সমস্ত জীবের মুগ্ধকারী বলিয়া জানিবে । এই তমোগুণ দেহীকে অনবধান, আলস্য ও নিদ্রাদ্বারা আবদ্ধ করে ॥৮॥
[হে] ভারত ! (হে অর্জ্জুন !) সত্ত্বং (সত্ত্বগুণ) সুখে (সুখে) রজঃ (রজোগুণ) কর্ম্মণি (কর্ম্মে) [জীবং] (জীবাত্মাকে) সঞ্জয়তি (আবদ্ধ করে), তমঃ তু (তমোগুণ কিন্তু) জ্ঞানম্ (জ্ঞানকে) আবৃত্য (আচ্ছাদন করিয়া) প্রমাদে (প্রমাদ) উত (এবং আলস্যাদিতে) সঞ্জয়তি (আবদ্ধ করে) ॥৯॥ হে অর্জ্জুন ! সত্ত্বগুণ সুখে ও রজোগুণ কর্ম্মে জীবাত্মাকে আবদ্ধ করে । তমোগুণ কিন্তু জীবের জ্ঞানকে আচ্ছাদন করিয়া প্রমাদ এবং আলস্যাদিতে আবদ্ধ করে ॥৯॥
[হে] ভারত ! (হে অর্জ্জুন !) সত্ত্বং (সত্ত্বগুণ) রজঃ তমঃ চ (রজঃ ও তমোগুণকে) অভিভূয় (অভিভূত করিয়া) ভবতি (উদ্ভূত হয়), রজঃ (রজোগুণ) সত্ত্বং তমঃ চ এব (সত্ত্ব ও তমোগুণকেও) তথা (তদ্রূপ) তমঃ (তমোগুণ) সত্ত্বং রজঃ (সত্ত্ব ও রজোগুণকে) [অভিভূয় ভবতি] (পরাজিত করিয়া প্রাধান্য লাভ করে) ॥১০॥ হে ভারত ! সত্ত্বগুণ—রজোগুণ ও তমোগুণকে অভিভূত করিয়া, রজোগুণ—সত্ত্ব ও তমোগুণকে এবং তমোগুণ—সত্ত্ব ও রজোগুণকে পরাজিত করিয়া নিজের প্রাধান্য বিস্তার করে ॥১০॥
যদা (যে কালে) অস্মিন্ দেহে (এই দেহে) সর্ব্বদ্বারেষু (সকল জ্ঞানেন্দ্রিয়ে) প্রকাশঃ (শব্দাদির স্বরূপ প্রকাশরূপ) জ্ঞানং (জ্ঞান) উপজায়তে (সম্যক্ উৎপন্ন হয়), তদা (তখনই) সত্ত্বম্ (সত্ত্বগুণ) বিবৃদ্ধং (বর্দ্ধিত হইয়াছে) ইতি (ইহা) বিদ্যাৎ (জানিবে), উত (এবং সুখলক্ষণ দ্বারাও বুঝিবে) ॥১১॥ যখন এই দেহে সমস্ত জ্ঞানেন্দ্রিয়ে বিষয়ের যাথার্থ্য প্রকাশরূপ জ্ঞান সমধিক উৎপন্ন হয়, তখনই সত্ত্বগুণ বিশেষ বৃদ্ধি পাইয়াছে বলিয়া জানিবে, এবং পূর্ব্বোক্ত সুখলক্ষণ দ্বারাও বুঝিবে ॥১১॥
[হে] ভরতর্ষভ ! (হে ভরতশ্রেষ্ঠ !) লোভঃ (লোভ) প্রবৃত্তিঃ (নানা কর্ম্ম করিবার ইচ্ছা) কর্ম্মণাম্ (বিবিধ কর্ম্মের) আরম্ভঃ (উদ্যম) অশমঃ (বিষয়ভোগে অনিবৃত্তি) স্পৃহা (বিষয়াভিলাষ) এতানি (এই সকল) রজসি (রজোগুণ) বিবৃদ্ধে [সতি] (বর্দ্ধিত হইলে) জায়ন্তে (উৎপন্ন হইয়া থাকে) ॥১২॥ হে ভরতশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুন ! রজোগুণ বিশেষ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইলে লোভ, কর্ম্মপ্রবৃত্তি, নানা কর্ম্মারম্ভ, ভোগে অনিবৃত্তি ও স্পৃহা এই সমস্ত উৎপত্তি লাভ করে ॥১২॥
[হে] কুরুনন্দন ! (হে কুরুবংশীয় !) অপ্রকাশঃ (বিবেক রাহিত্য) অপ্রবৃত্তিঃ চ (প্রযত্নহীনতা) প্রমাদঃ (অনবধানতা) মোহঃ এব চ (ও মিথ্যা অভিনিবেশ) এতানি (এই সকল চিহ্ন) তমসি (তমোগুণ) বিবৃদ্ধে [সতি] (প্রবল হইলে) জায়ন্তে (উৎপন্ন হয়) ॥১৩॥ হে কুরুনন্দন ! তমোগুণ প্রবল হইলে বিবেকাভাব, উদ্যমাভাব, অনবধানতা ও মিথ্যাভিনিবেশ এই সকল চিহ্ন প্রকাশ পাইয়া থাকে ॥১৩॥
যদা (যখন) সত্ত্বে (সত্ত্বগুণ) প্রবৃদ্ধে [সতি] (বৃদ্ধি পাইলে) দেহভৃৎ (দেহী-জীব) প্রলয়ং (মৃত্যু) যাতি (প্রাপ্ত হয়), তদা (তখন) উত্তমবিদাং (হিরণ্যগর্ভাদির উপাসকগণের) অমলান্ (পবিত্র) লোকান্ (লোকসমূহ) প্রতিপদ্যতে (প্রাপ্ত হয়) ॥১৪॥ সত্ত্বগুণের বৃদ্ধি সময়ে যদি জীব মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তবে হিরণ্যগর্ভাদির উপাসকগণের পবিত্র লোকসমূহে সে গমন করে ॥১৪॥
[জীবঃ] (জীব) রজসি [প্রবৃদ্ধে] (রজোগুণের বৃদ্ধিকালে) প্রলয়ং গত্বা (মৃত্যু হইলে) কর্ম্মসঙ্গিষু (কর্ম্মাসক্ত মনুষ্য মধ্যে) জায়তে (জন্মলাভ করে) ; তথা (তদ্রূপ) তমসি [বিবৃদ্ধে] (তমোগুণের বৃদ্ধিকালে) প্রলীনঃ [সন্] (মৃত্যুপ্রাপ্ত হইয়া) মূঢ়যোনিষু (পশু প্রভৃতির মধ্যে) জায়তে (জন্মগ্রহণ করে) ॥১৫॥ রজোগুণের বৃদ্ধিকালে মৃত্যু হইলে জীব কর্ম্মাসক্ত লোক-মধ্যে এবং তমোগুণের বৃদ্ধি কালে মৃত্যু ঘটিলে পশ্বাদির মধ্যে জন্মগ্রহণ করে ॥১৫॥
[পণ্ডিতাঃ] (পণ্ডিতগণ) সুকৃতস্য কর্ম্মণঃ (সাত্ত্বিক কর্ম্মের) নির্ম্মলং (নিরুপদ্রব) সাত্ত্বিকং (সুখকর) ফলং (ফল), রজসঃ তু (ও রাজসিক কর্ম্মের) দুঃখম্ (দুঃখময়) ফলম্ (ফল) [এবং] তমসঃ (তামসিক কর্ম্মের) অজ্ঞানং (অচেতনত্ব) ফলম্ (ফল) আহুঃ (বলিয়া থাকেন) ॥১৬॥ সাত্ত্বিক কর্ম্মের নির্ম্মল সুখকর ফল ও রাজসিক কর্ম্মের দুঃখময় ফল, এবং তামসিক কর্ম্মের অজ্ঞানময় বা অচেতনত্ব ফল—পণ্ডিতগণ বলিয়া থাকেন ॥১৬॥
সত্ত্বাৎ (সত্ত্বগুণ হইতে) জ্ঞানং (জ্ঞান), রজসঃ চ (ও রজোগুণ হইতে) লোভঃ এব (লোভই) সংজায়তে (উৎপন্ন হয়) । [এবং] তমসঃ (তমোগুণ হইতে) প্রমাদমোহৌ (প্রমাদ ও মোহ) ভবতঃ (উৎপন্ন হয়), অজ্ঞানং এব চ (এবং অজ্ঞানও) [ভবতি] (উৎপন্ন হইয়া থাকে) ॥১৭॥ সত্ত্বগুণ হইতে জ্ঞান ও রজোগুণ হইতে লোভ এবং তমোগুণ হইতে প্রমাদ, মোহ ও অজ্ঞানই উৎপন্ন হইয়া থাকে ॥১৭॥
সত্ত্বস্থাঃ (সত্ত্বগুণযুক্ত ব্যক্তিগণ) ঊর্দ্ধ্বং (সত্যলোক পর্য্যন্ত) গচ্ছন্তি (গমন করেন) রাজসাঃ (রজোগুণী লোক সকল) মধ্যে (মনুষ্যলোকে) তিষ্ঠন্তি (অবস্থান করেন), জঘন্য-গুণবৃত্তিস্থাঃ (প্রমাদ ও আলস্যাদি পরায়ণ) তামসাঃ (তমোগুণযুক্ত ব্যক্তিগণ) অধঃ (নরকাদি নিম্নতর লোক) গচ্ছন্তি (গমন করে) ॥১৮॥ সত্ত্বগুণযুক্ত জনগণ ঊর্দ্ধ্বে (সত্যলোক পর্য্যন্ত) গমন করে, রজোগুণযুক্ত ব্যক্তিগণ মধ্যে (মনুষ্যলোকে) অবস্থান করে, এবং ঘৃণ্য তামস প্রকৃতি ব্যক্তিগণ (নরকাদি) নিম্নতর লোকে গমন করে ॥১৮॥
যদা (যখন) দ্রষ্টা (জীব) গুণেভ্যঃ (গুণত্রয় হইতে) অন্যং (পৃথক্ কাহাকে) কর্ত্তারং (কর্ত্তা বলিয়া) ন অনুপশ্যতি (দর্শন করেন না), গুণেভ্য চ (এবং গুণত্রয়ের) পরং (অতীত ও অধিশ্বরকে) বেত্তি (জানিতে পারেন) [তদা] (তখন) সঃ (সেই জীব) মদ্ভাবং (আমাতে ভাবভক্তি) অধিগচ্ছতি (লাভ করেন) ॥১৯॥ যখন জীব গুণময় জগতে গুণত্রয় হইতে পৃথক্ কর্ত্তা দেখিতে পান না, এবং গুণত্রয়ের অতীত অধীশ্বরকে জানিতে পারেন, তখন তিনি আমার প্রতি ভাবভক্তি লাভ করেন ॥১৯॥
দেহী (জীব) দেহসমুদ্ভবান্ (দেহের উৎপাদক) এতান্ (এই) ত্রীন্গুণান্ (তিনটী গুণকে) অতীত্য (অতিক্রম করিয়া) জন্ম-মৃত্যু-জরা-দুঃখৈঃ (জন্ম, মৃত্যু, জরা ও দুঃখ হইতে) বিমুক্তাঃ [সন্] (সম্যক্ মুক্ত হইয়া) অমৃতম্ (নির্গুণ প্রেমরূপ অমৃত) অশ্নুতে (ভোগ করেন) ॥২০॥ জীব দেহের সংঘটক এই তিনটি গুণকে অতিক্রম করিলে জন্ম, মৃত্যু, জরা ও দুঃখ হইতে বিমুক্ত হইয়া নির্গুণ প্রেমরূপ অমৃত আস্বাদন করিতে থাকেন ॥২০॥
অর্জ্জুনঃ উবাচ (অর্জ্জুন বলিলেন) [হে] প্রভো ! (হে প্রভো !) কৈঃ লিঙ্গৈঃ (কি কি চিহ্ন দ্বারা) এতান্ (এই) ত্রীন্ (তিন) গুণান্ (গুণ) অতীতঃ (অতিক্রমকারী ব্যক্তি) [জ্ঞেয়ঃ] (জ্ঞাত) ভবতি (হন) ? কিমাচারঃ (কিরূপ আচরণ করেন ?) কথং চ (ও কি প্রকারে) এতান্ (এই) ত্রীন্গুণান্ (তিন গুণকে) অতিবর্ত্ততে (অতিক্রম করেন ?) ॥২১॥ অর্জ্জুন বলিলেন—হে প্রভো ! কি কি লক্ষণ দ্বারা ত্রিগুণাতীত ব্যক্তি পরিজ্ঞাত হন ? তাঁহার আচরণ কিরূপ এবং কি উপায় অবলম্বনে তিনি এই গুণকে অতিক্রম করেন ? ॥২১॥
শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ কহিলেন) [হে] পাণ্ডব ! (হে পাণ্ডপুত্ত্র !) যঃ (যিনি) প্রকাশং চ (প্রকাশ) প্রবৃত্তিং চ (প্রবৃত্তি) মোহম্ এব চ (এবং মোহ) সংপ্রবৃত্তানি (স্বতঃপ্রাপ্ত হইলে) ন দ্বেষ্টি (দ্বেষ করেন না) নিবৃত্তানি (উহাদের নিবৃত্তিও) ন কাঙ্ক্ষতি (আকাঙ্ক্ষা করে না) । যঃ (যিনি) উদাসীনবৎ (উদাসীনের ন্যায়) আসীনঃ (অবস্থিত) [সন্] (হইয়া) গুণৈঃ (গুণকার্য্য সুখদুঃখাদিকর্ত্তৃক) ন বিচাল্যতে (বিচালিত হন না) ; গুণাঃ (গুণ সকল) গুণেষু বর্ত্তন্তে (স্ব স্ব কার্য্যে প্রবৃত্ত হইতেছে) ইতি এবং (জ্ঞাত্ত্বা] (এই রূপ জানিয়া) অবতিষ্ঠতি (সুস্থির থাকেন) ন ইঙ্গতে (চঞ্চল হন না) । [যঃ] (যিনি) সমদুঃখসুখঃ (সুখে ও দুঃখে সমবুদ্ধি বিশিষ্ট) স্বস্থঃ (স্বরূপনিষ্ঠ) সমলোষ্ট্রশ্মকাঞ্চনঃ (মৃৎপিণ্ড প্রস্তর ও কাঞ্চনে সমভাবাপন্ন) তুল্যপ্রিয়াপ্রিয়ঃ (প্রিয় ও অপ্রিয় বস্তুতে তুল্যবুদ্ধি) ধীরঃ (বুদ্ধিমান্) তুল্যনিন্দাত্মসংস্তুতিঃ (নিজের নিন্দা ও স্তুতিতে সমানজ্ঞানবিশিষ্ট) মানাপমানয়োঃ (মান ও অপমানে) তুল্যঃ (সমান) মিত্রারিপক্ষয়োঃ (মিত্রপক্ষে ও শত্রুপক্ষে) তুল্যঃ (তুল্য) সর্ব্বারম্ভ-পরিত্যাগী (আসক্তি ও বৈরাগ্যের সর্ব্বপ্রকারারম্ভপরিত্যাগী) সঃ (সেই ব্যক্তি) গুণাতীতঃ (গুণাতীত বলিয়া) উচ্যতে (কথিত হন) ॥২২–২৫॥ শ্রীভগবান্ কহিলেন—হে পাণ্ডব ! যিনি (সত্ত্বকার্য্য) প্রকাশ, (রজঃ কার্য্য) প্রবৃত্তি ও (তমঃ কার্য্য) মোহ স্বতঃ আসিয়া উপস্থিত হইলে দ্বেষ করেন না, এবং উহাদের নিবৃত্তিরও আকাঙ্ক্ষা করেন না । যিনি উদাসীনের ন্যায় অবস্থিত হইয়া গুণকার্য্য (সুখ দুঃখাদি) দ্বারা বিচলিত হন না, ‘গুণসমূহ (নিজ নিজ বিষয়ে) প্রবৃত্ত হইতেছে’ এইরূপ মনে করিয়া সুস্থির থাকেন,—চঞ্চল হন না ; যিনি সুখে ও দুঃখে সমভাবাপন্ন, আত্মনিষ্ঠ, মৃত্তিকাখণ্ড, পাথর ও সুবর্ণে সমবুদ্ধিযুক্ত, প্রিয় ও অপ্রিয় বস্তুলাভে সমজ্ঞানবিশিষ্ট, ধীর, নিজের নিন্দা ও স্তুতিতে তুল্যবুদ্ধি সম্পন্ন ; মান ও অপমানে, মিত্রপক্ষ ও শত্রুপক্ষে তুল্যভাব এবং আসক্তি ও বৈরাগ্যের উৎপাদকসমূহপরিত্যাগী—সেই ব্যক্তিই গুণাতীত বলিয়া কথিত হন ॥২২–২৫॥
যঃ (যিনি) অব্যভিচারেণ (জ্ঞান-কর্ম্মাদি-দোষবর্জ্জিত) ভক্তিযোগেন (শুদ্ধভক্তিযোগ দ্বারা) মাং চ (শ্যামসুন্দরাকার পরমেশ্বর আমাকেই) সেবতে (সেবা করেন), সঃ (তিনি) এতান্ (এই) গুণান্ (গুণত্রয়কে) সমতীত্য (সম্যক্ অতিক্রম করিয়া) ব্রহ্মভূয়ায় (চিৎস্বরূপ-সিদ্ধির) কল্পতে (যোগ্য হন) ॥২৬॥ যিনি (জ্ঞানকর্ম্মাদি দোষবর্জ্জিত) শুদ্ধ ভক্তিযোগ দ্বারা (শ্যামসুন্দরাকার) আমাকেই সেবা করেন, তিনি এই গুণত্রয়কে সম্যক্ অতিক্রম করিয়া চিৎস্বরূপসিদ্ধির যোগ্য হন ॥২৬॥
হি (যে হেতু) অহম্ (আমি) ব্রহ্মণঃ (অখণ্ড চৈতন্যের) অব্যয়স্য (অফুরন্ত) অমৃতস্য (অমৃতের), শাশ্বতস্য (নিত্য) ধর্ম্মস্য (লীলার), ঐকান্তিকস্য চ (ও ঐকান্তিক) সুখস্য (প্রেমসুধাস্বাদনের) প্রতিষ্ঠা (মূল অবলম্বন) ॥২৭॥ আমিই অখণ্ড চৈতন্যের, অফুরন্ত অমৃতের, নিত্যলীলার ও ঐকান্তিক প্রেমসুধাস্বাদনের মূল অবলম্বন ॥২৭॥
ইতি চতুর্দ্দশ অধ্যায়ের অন্বয় সমাপ্ত ॥ ইতি চতুর্দ্দশ অধ্যায়ের বঙ্গানুবাদ সমাপ্ত ॥
—···—
|
সূচিপত্র: মঙ্গলাচরণম্ গ্রন্থ-পরিচয় প্রকাশকের নিবেদন ১ সৈন্য-দর্শন ২ সাংখ্যযোগ ৩ কর্ম্মযোগ ৪ জ্ঞানযোগ ৫ কর্ম্মসন্ন্যাসযোগ ৬ ধ্যানযোগ ৭ জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ ৮ তারকব্রহ্মযোগ ৯ রাজগুহ্যযোগ ১০ বিভূতিযোগ ১১ বিশ্বরূপ-দর্শনযোগ ১২ ভক্তিযোগ ১৩ প্রকৃতিপুরুষ-বিবেক-যোগ ১৪ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ ১৫ পুরুষোত্তমযোগ ১৬ দৈবাসুরসম্পদ্-বিভাগ যোগ ১৭ শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ ১৮ মোক্ষযোগ গীতামাহাত্ম্যম্ |
|||||||||||||||||||||||||||
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥ | ||||||||||||||||||||||||||||
© Sri Chaitanya Saraswat Math, Nabadwip, West Bengal, India. For any enquiries please visit our contact page. |